সারাদেশ

কৌশলে পাল্টে যাচ্ছে ইয়াবার রং!

কক্সবাজার-টেকনাফে যখন আয়োজন করে ইয়াবা পাচারকারীদের আত্মসমর্পণপ্রক্রিয়া চলছে তখনো এই নেশাদ্রব্য মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে দেশে আসছে। সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে ইয়াবাপাচারে স্থলভাগের কিছু অংশ এবং সমুদ্রপথ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ‘সোর্সমানি’ বেড়েছে। এ ছাড়া লাল রঙের পরিবর্তে এখন হলুদ ও সাদা রঙের ইয়াবা ট্যাবলেট আসছে।

কক্সবাজারে তিনজন আত্মস্বীকৃত ইয়াবাপাচারকারীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা শিগগিরই আত্মসমর্পণপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হবেন বলে জানিয়েছেন।

ওই পাচারকারীরা জানিয়েছেন, ধারাবাহিক অভিযানে ইয়াবাপাচার কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সেটি পুরোপুরি বন্ধ করাও সম্ভব নয়। তাঁরা বলছিলেন, স্থলভাগে বিজিবি ও সমুদ্রপথে কোস্ট গার্ডকে ফাঁকি দিয়ে এসব ইয়াবা পাচার হয়ে আসছে। তাঁদের দাবি, সীমান্তে দায়িত্ব পালন করে—এমন বাহিনীগুলোর নাম দিয়ে ‘সোর্সমানি’ তোলে কতিপয় ব্যক্তি। সাম্প্রতিক সময়ের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একাধিক সোর্স নিহতও হয়েছে।

তাঁরা জানান, শাহপরীর দ্বীপের কবির আহমদ নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইয়াবা ও মানব পাচারের অভিযোগ আছে। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে ‘সোর্স’ হিসেবেও এলাকায় পরিচিত। একইভাবে জালিয়াপাড়া এলাকার মোহাম্মদ শামীমও ‘সোর্স’ হিসেবে পরিচিত। টেকনাফ সীমান্তের স্থলভাগের প্রায় প্রতিটি পাড়ায় ‘সোর্স’ রয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা।

এই ইয়াবা কারবারিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইয়াবার বড় চালান আনতে হলে অবশ্যই সীমান্তে দায়িত্ব পালন করে—এমন বাহিনীর সঙ্গে আঁতাত করতে হয়। এই আঁতাতপ্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কথিত সোর্সরা। একই সঙ্গে সোর্সদের অনেকেই পাচারেও জড়িত। তিন পাচারকারীর ভাষ্য, সীমান্তের যে অংশ দিয়ে ইয়াবা পাচার হবে, সেই অংশে যদি বাজার কিংবা কোনো দোকান থাকে, তবে সেগুলো সন্ধ্যার পর বা রাত ৮টার মধ্যেই কৌশলে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এরপর রাতের অন্ধকারে ইয়াবা পাচার হয়ে আসে দেশে। কথিত সোর্সরা এই সুযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। তাঁরা আরো বলছেন, এর মধ্যে তাঁরা জানতে পেরেছেন যে এখন প্রতিটি ইয়াবার জন্য চার টাকা হারে ‘সোর্সমানি’ দিতে হয়। আগে দিতে হতো দুই টাকা হারে।

তাঁদের পরিচয় প্রকাশ করা হবে না—এমন শর্তে আত্মস্বীকৃত এই তিন ইয়াবাপাচারকারী কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য দিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, তাঁরা আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। ভবিষ্যতে সোর্সরা তাঁদের নতুন করে ঝামেলায় ফেলতে পারে। এ আশঙ্কায় তাঁরা নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। তাঁরা বলছিলেন, পাঁচ মাস ধরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধারাবাহিকভাবে ইয়াবাবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। এর পরও কেন ইয়াবা বন্ধ হচ্ছে না?

এর মূল কারণ সীমান্তের চোরাগলি ও সমুদ্রপথ। সীমান্তে বিজিবির নিয়মিত টহল আছে। কিন্তু চোরাগলি পেরিয়ে ‘সোর্সরা’ ঠিকই ইয়াবা পাচারের পথ খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। আর মাছ ধরার ট্রলারে করে বিশেষ কায়দায় সমুদ্রপথে ইয়াবা আসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজারে যখন মাদকপাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে তোড়জোড় চলছে তখনই চট্টগ্রামে অব্যাহতভাবে ইয়াবা উদ্ধার হচ্ছে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) গত ২০ জানুয়ারি এক হাজার সাদা ইয়াবাসহ মো. ইদ্রিস নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে। ইদ্রিস কক্সবাজারের টেকনাফের বাসিন্দা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, লাল রঙের ইয়াবার চেয়ে সাদা ইয়াবার মান ভালো। এ কারণে দামও বেশি। এ ছাড়া সীমান্তে কড়াকড়ি থাকার পরও বেশি ‘সোর্সমানি’ দিয়ে ইয়াবাগুলো পাচার করা হয়েছে। এসব ইয়াবা মুরাদপুরে একজনের কাছে হস্তান্তরের কথা ছিল।

ইয়াবার রং পরিবর্তনের বিষয়ে ওই তিন পাচারকারীর ভাষ্য, লাল রঙের ইয়াবা এখন বহুল পরিচিত রং। তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধোঁকা দিতে ইয়াবার রং পরিবর্তন করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে টেকনাফের ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক শহীদুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার বলেন,‘বিজিবির অভিযানে এখনো সাদা রঙের ইয়াবা ধরা পড়েনি। তবে মিশ্র রঙের পাওয়া গেছে।’

‘সোর্সমানি’ বিষয়ে বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি কক্সবাজারে একটি মিটিংয়ে আছি। অফিসে আসুন। আলাপ হবে।’

কোস্ট গার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ফয়জুল ইসলাম মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশাল বঙ্গোপসাগরে শত শত মাছ ধরার ট্রলার রাত-দিন মাছ ধরে। সব কটি ট্রলারই প্রায় অভিন্ন। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া ইয়াবা উদ্ধার অভিযান কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ সব কটি মাছ ধরার ট্রলার তো আর তল্লাশি করা সম্ভব হয় না।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইয়াবাপাচার আগের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তবে বন্ধ হয়ে গেছে সেই কথা বলার সময় এখনো আসেনি।’

‘সোর্সমানি’ বিষয়ে কোস্ট গার্ডের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সোর্সমানি বৃদ্ধি সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। তবে সোর্সরা হয়তো কোনো বাহিনীর নামে পাচারকারীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে পারে। কিন্তু এর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ জড়িত—এটি বিশ্বাস করা যায় না।’

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সহকারী কমিশনার (দক্ষিণ) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ইয়াবার প্রকোপ কিছুটা কমেছে। এটি অভিযানের সুফল। তবে এখনো পাচার পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।’ (কালের কণ্ঠ)

বার্তা কক্ষ
২৭ জানুয়ারি,২০১৯

Share