সাংবাদিক আওরঙ্গজেব সজীবের রহস্যজনক মৃত্যুর প্রায় তিন মাস পার হলেও রহস্যের কিনারা হয়নি। সাংবাদিক সজীব সদরঘাট থেকে চাঁদপুরগামী এমভি-তাকওয়া লঞ্চ থেকে ধলেশ্বরী নদীতে পড়ে যান এবং তিন দিন পর নদী থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তার লঞ্চে যাওয়া এবং নদীতে পড়ে যাওয়ার পুরো ঘটনাটিই ছিল রহস্যঘেরা। লাশ উদ্ধারের পর তার মোবাইল ফোনের কল রেকর্ডের সূত্রে আলিফা খাতুন অঞ্জনা ওরফে মুনিয়া (৩০) নামে এক তরুণীকে আটক করে র্যাব। তিনি নিজেকে সজীবের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করছেন। অঞ্জনার মতে, নদীতে পড়ে যাওয়ার আগের রাতে সজীব তার কাছেই ছিলেন।
তবে স্বজনরা বলছেন, সজীবের মৃত্যু রহস্যের কার্যকর তদন্তই হচ্ছে না। তার চাঁদপুরের লঞ্চে করে যাওয়ার কোনো কারণ নেই এবং মৃত্যুর পর দ্বিতীয় স্ত্রীর অভির্ভাবের বিষয়টিও রহস্যজনক। পরিবারের দায়ের করা হত্যা মামলায় ‘দ্বিতীয় স্ত্রীকে’ গ্রেপ্তার দেখানো হলেও তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ।
এখন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্প্রতি সজীবের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পুলিশের হাতে গেছে। সেখানে নিহতের শরীরের কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ময়নাতদন্তে প্রাথমিকভাবে সজীবের মৃত্যুর কারণ হিসেবে পানিতে ডুবে যাওয়াকেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ভিসেরা পরীক্ষার ফলাফল প্রয়োজন বলে মন্তব্য করা হয়। এ কারণে পুলিশ অন্যান্য বিষয়কে গুরুত্ব না দিয়ে ভিসেরা রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছেন বলে জানান তদন্তকারীরা।
সজীবের স্ত্রী মোর্শেদা বেগম নিশি বলেন, ‘আমার স্বামীর কেউ নেই চাঁদপুরে বা মুন্সিগঞ্জে। সে কেন ওই রুটের লঞ্চে উঠবে? মেয়েটি (দ্বিতীয় স্ত্রী পরিচয় দানকারী) বলছে তিন বছর প্রেম করার পর ৪ তারিখে (৪ ডিসিম্বর) তারা বিয়ে করেছে। ঘটনার আগের রাতেও তারা একসঙ্গে ছিল। আমিতো এসব জানতাম না। কোনো সমস্যাও ছিল না। তবে কেন আমার স্বামী নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে? পুরো বিষয়টাই রহস্যজনক।’
নিশি আরো বলেন, ‘মেয়েটি কথাবার্তা রহস্যজনক হলেও পুলিশ তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে না। কোনো তদন্তই হয়নি। এতোদিন হলো ফরেনসিক রিপোর্টও আসেনি। আমার স্বামী যদি আত্মহত্যা করে তাহলে আমার কোনো প্রশ্ন নাই। তবে এমন কোনো বিষয় এখন পর্যন্ত দেখি না যে সে আত্মহত্যা করতে পারে। পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হতে পারে। মেয়েটিকেও কেউ ব্যবহার করতে পারে।’
পুলিশ জানায়, সজীবের লাশ উদ্ধারের পর তার স্ত্রী নিশি মুন্সিগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। সজীব নিখোঁজ থাকা অবস্থায় র্যাব তাঁর মোবাইল ফোনের রেকর্ডের সূত্রে মুনিয়া নামের এক তরুণীকে শনাক্ত করে। লাশ উদ্ধারের পর তাকে আটক করে র্যাবের গোয়েন্দারা। ওই তরুণী নিজেকে সজীবের দ্বতীয় স্ত্রী বলে পরিচয় দেন। পরে তাকে সজীব হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার দেখায় মুন্সিগঞ্জ থানা পুলিশ। কথিত ওই স্ত্রীর প্রকৃত নাম আলিফা খাতুন অঞ্জনা। বগুড়ার মেয়ে অঞ্জনা মাস্টার্স পাস করেছেন। তিনি রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। সজীবের পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরাও তার মৃত্যুর আগে অঞ্জনার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
মামলাটি তদন্ত কর্মকর্তা ও মুক্তারপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইউনুস আলী বলেন, ‘আমরা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেয়েছি। সেখানে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। শরীরে আঘাত নেই। তবে ভিসেরা পরীক্ষায় পুরো বিষয়টি পরিস্কার হবে বলে উল্লেখ আছে। তাই আমরা ভিসেরার জন্য অপৈক্ষা করছি।’ জানতে চাইলে এসআই ইউনুস আলী বলেন, ‘সজীবের দ্বিতীয় স্ত্রী অঞ্জনা বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ কারাগারে বন্দী আছেন। তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। প্রয়োজন হলে রিমান্ডে নেওয়া হবে। তবে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানা যায়নি।’
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, অঞ্জনা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন- তিন বছর ধরে সজীবের সঙ্গে তার প্রেম ছিল। গত ৪ ডিসেম্বর তাদের বিয়ে হয়। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর নদীতে পড়ার আগের রাতে অঞ্জনার সঙ্গে ছিলেন সজীব। তবে পরে তার সঙ্গে আর কথা হয়নি। সজীবের মোবাইল ফোনে কল করলে তাকওয়া লঞ্চের এক যাত্রী ফোনটি ধরেন। অঞ্জনা দাবি করেছেন- সজীবের মৃত্যুর ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। অঞ্জনার ভাষ্য, বিয়ের পরে তিনি সজীবের প্রথম বিয়ে এবং প্রথম পক্ষে দুই ছেলে-মেয়ে আছে বলে জেনেছেন। এটি নিয়ে তাদের মধ্যে বড়গ ধরনের ঝগড়াও হয়নি। অঞ্জনাও বলছেন সজীবের আত্মহত্যার কারণ তার জানা নেই।
সজীবের স্ত্রী নিশি বলেন, ‘কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথা বলে পুলিশ আমাকে বারবার বোঝাতে চাইছে সজীব আত্মহত্যা করেছে। সজীব তার মোবাইল ফোন, পরিচয়পত্র লঞ্চে রেখে সচেতনভাবে পানিতে ঝাপ দিয়েছে। এটা কী করে হয়? পাগলও এমন কাজ করে না। সজীব কোথায়, কীভাবে কার সঙ্গে ছিল এসব ভালো করে তদন্ত করলে আসল ঘটনা বের হবে।’
তিনি জানান, অঞ্জনা ওরফে মুনিয়া নামের ওই তরুনীর সঙ্গে সজীবের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল বলে প্রমাণ পেয়েছেন নিশি। অঞ্জনার একটি বায়োডাটা সজীবের বাসায় ছিল। সেখানে যে মোবাইল ফোন নম্বর ছিল ওই নম্বর থেকেই সজীবকে ঘটনার দিন সকালে ফোন দেওয়া হয়। পরে সজীব বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হন। তিন দিন নিখোঁজ সজীবকে ধলেশ্বরী নদীতে খুঁজেছেন স্বজনরা। তবে ধরা পড়ার আগে অঞ্জনা কারো কাছে সজীবের খোঁজও নেয়নি। এসব যুক্তি দেখিয়ে নিশি বলছেন, অঞ্জনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেই সজীবের মৃত্যুর প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর চাঁদপুরগামী এমভি তাকওয়া লঞ্চ থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন বাংলামেইল২৪ ডটকম-এর সাবেক ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধি আওরঙ্গজেব সজীব (৪০)।
কয়েকজন যাত্রী পুলিশকে জানায়, মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র রেখে সজীব নিজেই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছেন। এই ঘটনার তিনদিন পর ২৭ ডিসেম্বর ধলেশ্বরী নদী থেকে তার অর্ধগলিত ভাসমান লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সজীব দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, সময় টেলিভিশনসহ কয়েকটি গণমাধ্যমেরও ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিনিধি ছিলেন।
সূত্র : বাংলামেইল
চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক ||আপডেট: ০২:৫৪ অপরাহ্ন, ১৪ মার্চ ২০১৬, সোমবার
এমআরআর