রোযা বা রোজা অথবা সিয়াম ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়। সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোযা। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি সবল মুসলমানের জন্য রমযান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ এবং অবশ্য পালনীয়।
রমযানের প্রতিটি দিনের সূচনা হয় সেহরির মাধ্যমে। আর সমাপ্তি হয় ইফতারের মাধ্যমে। এ জন্য রমযানের রোজা ও তারাবির পাশাপাশি আরো যে উপলক্ষ ও ইবাদত ব্যাপকভাবে সমাজকে স্পর্শ করে তা সেহরি ও ইফতার।
রোজার প্রস্তুতি ঘোষণা করতে হয় সেহরির মাধ্যমে এবং সমাপ্তি ঘোষণা করতে হয় ইফতারের মাধ্যমে।
পবিত্র কোরআন-হাদিসের আলোকে সেহরি ও ইফতার সম্পর্কে বিশদ আলোচনা এখানে সন্নিবেশিত করা হলো-
সেহরির গুরুত্ব:
রোজা রাখার উদ্দেশ্য মুসলমানরা সুবহে সাদিকে আগে সেহরি খেয়ে থাকেন। রোজা পালনের জন্য সেহরি খাওয়া সুন্নাত ও অধিক পুণ্যের কাজ।
ক্ষুধা না থাকলেও সামান্য একটু পানি পান করাকেও সেহরি হিসেবে গণ্য করা হয়।
সেহরি খাওয়ার মধ্যে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর সুন্নাহর অনুসরণ করা হয়। অন্যদিকে সেহরি খাওয়ার মাধ্যমে রোজা রাখার শক্তিদ অর্জিত হয়।
সেহরি খেলে রোজাদার সহজে দুর্বল ও মনোবলহীন হয়ে পড়েন না, সারাদিন দীর্ঘ সময়ের উপবাস বা অনাহারে থাকলেও কর্মঠ থাকার প্রাণশক্তি আসে এবং সিয়াম পালন সহ্যসীমার মধ্যে থাকে।
যতোক্ষণ পর্যন্ত সুবহে সাদিক না হয় অর্থাৎ পূর্ব দিগন্তে সাদা বর্ণ না দেখা যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেহরি খাওয়ার অনুমতি আছে। সুবহে সাদিক হয়ে গেলে তারপর আর কিছু খাওয়াদাওয়ার সুযোগ নেই।
সেহরি খাওয়ার সময়সীমা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আর তোমরা পানাহার করো, যতোক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের সাদা রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করো। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭)
রাসূলুল্লাহ (সা.) সেহরি খেতে আদেশ করেছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, তোমরা সেহরি খাও, কারণ সেহরিতে বরকত রয়েছে।
রাসূল (সা.) কখনো সেহরি থেকে বিরত থাকতেন না। সাহাবায়ে কেরামকেও সেহরির ব্যাপারে তাগিদ দিতেন এবং নিজের সঙ্গে শরিক করতেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে একজন সাহাবী এলেন যখন তিনি সেহরি খাচ্ছিলেন। রাসূল (সা.) তাকে দেখে বললেন, এ খাবার বরকতের। আল্লাহ পাক বিশেষভাবে তোমাদের তা দান করেছেন। কাজেই তোমরা সেহরি খাওয়া ছেড়ে দিও না। (নাসাঈ)
মুসলিম শরীফে হযরত আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমাদের এ সিয়াম ও আহলে কিতাবদের (ইহুদী ও খৃষ্টান) রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সেহরি খাওয়া।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যেসব মুসলমান ভোরের এ সময়ে জেগে আল্লাহ পাকের হুকুম মেনে সেহরি খেতে বসে, আল্লাহ পাক খুশি হয়ে তাদের জন্য বিশেষ রহমত অবতীর্ণ করেন এবং মহান আল্লাহর ফেরেশতারা সেহরি গ্রহণকারীদের জন্য বিশেষ দোয়া করতে থাকেন। (মুসনাদে আহমদ)
সেহরি খাওয়ার উত্তম সময়ও নির্দিষ্ট করা আছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমরা রাতের অন্ধকার প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত পানাহার কর। (বাকারা-১৮৭)
দেশ ও অঞ্চলভেদে সেহরিতে খাবারের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। তবুও প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সেহরির সময় খেজুরকে সর্বোত্তম খাদ্যদ্রব্য বলেছেন।
আবু দাউদ শরীফে এক বর্ণনায়- খেজুরকে সর্বোত্তম সেহরি বলেছেন রাসূল (সা.)।
এজন্য সেহরির সময় দু-একটি খেজুর খেলে এ সুন্নত আদায় হবে। এ ছাড়া আধুনিককালের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান মতে, খেজুরের ভেতর যে শক্তি ও পুষ্টিগুণ রয়েছে তা রোজাদারের জন্য অনেক বেশি শক্তিদায়ক এবং বিশেষ উপকারী।
অনেকে তারাবির পর খানা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, অলসতা করে সেহরি খাওয়ার জন্য পুনরায় জাগ্রত হওয়াকে বোঝা মনে করেন তাদের জেনে রাখা দরকার যে, এটা সুন্নতের পরিপন্থী কাজ।
এতে সেহরির ফজিলত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। সেহরির সময় একটু আগেভাগে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা বড় সৌভাগ্যের বিষয়।
সেহরি খাওয়ার পর রোজার নিয়ত অন্তরে করাই যথেষ্ট, মুখেও যদি বলে তাহলে ভালো ‘আমি আগামীকাল রমযান মাসের রোজা রাখার নিয়ত করলাম’। (জাওয়াহিরুল ফিকহ)
সেহরি খাওয়া সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা সেহরি খাওয়া বান্দার ওপর রহমত নাজিল করেন।
সেহরি খাওয়া যেহেতু সুন্নত, তাই সুন্নতের ওপর আমল করার জন্য ক্ষুধা না হলেও পানি বা অন্য কিছু খেয়ে নেয়া উচিত।
কারণ হাদিস শরিফে এসেছে ‘তোমরা সেহরি খাও, কেননা সেহরিতে বরকত রয়েছে।’ সেহরি দেরিতে খাওয়া মুস্তাহাব। তবে এতো বিলম্ব না করা উচিত, যার কারণে রোজার মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়ে পড়ে।
হযরত ইয়ালা বিন মুররাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালার কাছে তিনটি বস্তু অধিক পছন্দনীয়। (এক) সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাড়াতাড়ি ইফতার করা। (দুই) সেহরি দেরিতে খাওয়া। (তিন) নামাজে হাত বেঁধে আল্লাহর ধ্যান-খেয়ালে আদবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা।
সেহরির মধ্যে বিলম্ব করা মুস্তাহাব। সেহরি খাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব করার অর্থ হলো, ততক্ষণ পর্যন্ত পানাহার করা বৈধ যতক্ষণ শুভ্র রেখা উদিত না হয়। যখন শুভ্র রেখা উদিত হয়ে যায় তখন পানাহার বর্জন করা চাই।
বর্তমানে আমাদের দেশের আবহাওয়া দফতর থেকে সেহরি ও ইফতারের সঠিক সময় আগেই ঘোষণা করা হয়ে থাকে এবং মসজিদের মুয়াজ্জিনরাও সেই সময়সূচি অনুসরণ করে আজান দিয়ে থাকেন। ওলামায়ে কেরামের পরামর্শ অনুযায়ী সতর্কতা হিসেবে প্রয়োজনের সামান্য আগে-পিছে করা হয়।
ইফতারের গুরুত্ব:
রোজা পালনে ইফতারের গুরুত্বও অপরিসীম। আবার সময়মতো ইফতার করার মধ্যেও রয়েছে অশেষ সওয়াব ও কল্যাণ।
রাসূলে কারিম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এরশাদ করেন, তোমরা ইফতারের সময় হওয়ামাত্র ইফতার করে নাও। এতটুকু বিলম্ব করো না।
এ সম্পর্কে তিরমিজি শরীফে উল্লেখ আছে যে, আমি ওই ব্যক্তিকে সর্বাধিক ভালোবাসি যে ইফতারের সময় হওয়া মাত্র ইফতার করে নেয়।
আবু দাউদ শরীফে আছে, হযরত রাসূলে পাক (সা.) যখন ইফতার করতেন, তখন বলতেন, আমার তৃষ্ণা নিবৃত্ত, আমার শিরা উপশিরা সিক্ত হয়েছে এবং আল্লাহপাক পরওয়ারদেগারের পুরস্কার নির্ধারিত হয়ে গেছে।
হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, মানুষ ততদিন কল্যাণের মধ্যে থাকবে যতদিন তারা ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করে নেবে। (বুখারি ও মুসলিম)
ইফতারের সময় এ দোয়া পড়তে হয়-
اَللهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَ عَلَى رِزْقِك أَفْطَرْتُ
আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু।
অর্থ- হে আল্লাহ! তোমার জন্যই রোজা পালন করলাম, আর তোমার প্রদত্ত রিজিক দিয়েই ইফতার করছি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) কয়েকটি তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনো খেজুর, অর্থাৎ খোরমা দিয়ে ইফতার করতেন। আর যদি তাও না পেতেন, তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন।
এ ছাড়া ইফতারের আগ মুহূর্তটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়। দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম সময়।
প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ইফতার করার সময় রোজাদারের দোয়া কবুল হয়ে থাকে। (আবু দাউদ)
বিদায় হজের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছিলেন, দাস-দাসীদের প্রতি সর্বদা সদ্ব্যবহার করবে। তাদের ওপর কোনোরকম অত্যাচার করবে না। তোমরা যা খাবে তাদেরও তাই খাওয়াবে; যা পরবে তাই পরাবে। ভুলে যেও না তারও তোমাদেরই মতো মানুষ।
অতএব আমরা যখন ঘরে ইফতার করি তখন যেন বাসার গৃহকর্মী ও অধীনস্থদের নিয়ে পরিবারের সবাই একসঙ্গে ইফতার করি। কোনো রোজাদারকে ইফতার করানো অত্যধিক ফজিলতের কারণ।
রমযানের সুন্নত আমল সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ইফতার।
হযরত সালমান ফারসী (রা.) বর্ণিত হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ। একটি আনন্দ ইফতারের সময়, অপর আনন্দ তার রবের সাথে সাক্ষাত।
হাদিসে কুদসিতে আছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ঐ বান্দাগণ যারা বিলম্ব না করে তাড়াতাড়ি ইফতার করে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সে পর্যন্ত দ্বীন ইসলাম বিজয়ী থাকবে যতদিন মানুষ শিঘ্র ইফতার করবে। কেননা ইহুদি ও নাসারাগণ দেরিতে ইফতার করে।
সময়মতো ইফতার করা যেমন ফজিলতের তেমনি রোযাদারকে ইফতার করানোর ফজিলতও অনেক।
হযরত সালমান ফারসী (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করবে।
ঐ রোযাদারের সওয়াবের সমপরিমাণ সওয়াব সে লাভ করবে, তবে ঐ রোযাদারের সওয়াবে কোনো কম করা হবে না।
সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমরা সবাই রোযাদারকে ইফতার করাতে সক্ষম নই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, পানি মিশ্রিত এক চুমুক দুধ বা একটি শুকনো খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দ্বারাও যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে আল্লাহ তাকে এ পরিমাণ সওয়াব দান করবেন।
আর যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে পরিতৃপ্তভাবে খানা খাওয়াবে আল্লাহ তাআলা তাকে আমার হাউজ (হাউজে কাওসার) হতে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করার পূর্বে তৃষ্ণার্ত হবে না। (বায়হাকী ওয়াবুল ঈমান, মেশকাত)।