আনন্দ ও সংযম মানবজীবনের দু’টি অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু জীবনযাত্রার অন্য অনেক অনুষঙ্গের মতো এদু’টি বিষয়েও বহু মানুষ ও বহু জাতি প্রান্তিকতার শিকার হয়েছে। আর মর্মান্তিক বাস্তবতা এ যে, এটা শুধু মানুষের কর্মগত বিচ্যুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তার চিন্তা, দর্শন ও মূল্যবোধকেও আক্রান্ত করেছে। জীবনের এ অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, আনন্দ ও উপভোগ এবং ত্যাগ ও সংযমের পরিচ্ছন্ন ও ভারসাম্যপূর্ণ ধারণা লাভের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।
কুরআন মজীদে ভোগবাদী জীবনদর্শনকে যেমন কুফরি দর্শন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তেমনি আহবার ও রোহবান-এর প্রবর্তিত সন্ন্যাসবাদকেও আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আখিরাত-বিমুখ ভোগবাদী জীবনদর্শন সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ : আপনি কি তাকে লক্ষ্য করেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজ ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কর্ণকুহরে মোহর করে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর ওপর রেখেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পরে কে তাকে পথনির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? তারা বলে, ‘একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন, আমরা মরি ও বাঁচি আর কালই আমাদেরকে ধ্বংস করে। বস্তুত এ বিষয়ে তাদের কোনো জ্ঞান নেই, তারা তো কেবল মনগড়া কথা বলে’। (সূরা জাছিয়া : ২৩-২৪)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : তার স¤প্রদায়ের প্রধানগণ, যারা কুফরি করেছিল ও আখিরাতের সাক্ষাতকে অস্বীকার করেছিল এবং যাদেরকে আমি দিয়েছিলাম পার্থিব জীবনে প্রচুর ভোগসম্ভার তারা বলেছিল, ‘এতো তোমাদের মতোই একজন মানুষ; তোমরা যা আহার কর, সে তাই আহার করে এবং তোমরা যা পান কর সেও তা-ই পান করে। যদি তোমাদেরই মতো একজন মানুষের আনুগত্য কর তবে তোমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সে কি তোমাদেরকে এ প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তোমাদের মৃত্যু হলে এবং তোমরা মৃত্তিকা ও অস্থিতে পরিণত হলেও তোমাদেরকে উত্থিত করা হবে? অসম্ভব! তোমাদেরকে যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা অসম্ভব। একমাত্র পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন, আমরা মরি-বাঁচি এই খানেই এবং আমরা উত্থিত হব না’। (সূরা মুমিনূন : ৩৩-৩৭)।
এই ভোগবাদী জীবন-দর্শনের মূল কথা যে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও দুনিয়ার মোহ তা উপরের আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়। এছাড়া সূরা ইবরাহীম (আয়াত ৩-৪) এবং সূরা না হলেও (আয়াত ১০৬-১০৯) এ বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসবাদেরও কোনো স্থান ইসলামে নেই। কুরআন মজীদে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ওই পথকে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে : তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ তোমাদেরকে যে রিজিক দান করেছেন তোমরা তার কিছু হালাল ও কিছু হারাম করেছ? বলুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এর অনুমতি দিয়েছেন না তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করছ? যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা উদ্ভাবন করে, কিয়ামত-দিবস সম্বন্ধে তাদের কী ধারণা? নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহ পরায়ণ, কিন্তু তাদের অধিকাংশই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না’। (সূরা ইউনুস : ৫৯-৬০)।
মোটকথা, ভোগবাদ ও বৈরাগ্যবাদ দু’টোই ইসলামে প্রান্তিকতা হিসেবে চিহ্নিত এবং এই দু’য়ের মাঝে আনন্দ ও সংযমের ভারসাম্যপূর্ণ সম্মিলন ইসলামের বৈশিষ্ট্য। এরই সঙ্গে ইসলাম মুমিনকে এমন এক আনন্দ-ভুবনের সঙ্গে পরিচিত করে যার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর মানুষ লাভ করে অটুট প্রশান্তি, যার জন্য জগতের সকল ভোগ-বিলাসকে কোরবান করে দেওয়া যায়।
পবিত্র মাহে রমজান সেই আনন্দ ও সংযমের বারতা নিয়ে আসে। মুমিনের প্রতিটি রোজা যেন আনন্দ ও সংযমের এক অনন্য মোহনা। আল্লাহর হুকুমে দিবসের সংযম আর আল্লাহরই হুকুমে সন্ধ্যার আনন্দ-এ যেন ইসলামের সামগ্রিক আদর্শেরই এক সংক্ষিপ্ত প্রতিচ্ছবি। আর এই অনাবিল আনন্দ যেন সেই পরম আনন্দেরই শুভ ইশারা, যা আল্লাহ মুমিনকে আখিরাতে দান করবেন।
নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রোজাদার দু’টি আনন্দ উপভোগ করে। যখন সে ইফতার করে তখন ইফতার খাবার গ্রহণ তাকে আনন্দিত করে আর যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাত করে তখন তার রোজা তাকে আনন্দিত করে’। (সহিহ বুখারি)। এ মাসের ওসিলায় আল্লাহ যেন আমাদেরকে দান করেন আনন্দের সংযম এবং সংযমের আনন্দ।
বিভাগ : মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক, ইসলামী চিন্তাবিদ , শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম ।
চাঁদপুর টাইমস
১০এপ্রিল ২০২৩
এজি