সব রেকর্ড ভেঙে প্রতি টন রডের দাম ৮৮ হাজার টাকা

দেশের বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রডের দাম। সেই ধারাবাহিকতায় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতি টন রডের দাম ৮৮ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এর আগে এতো দাম দেখা যায়নি রডের।

গত বছরের (২০২১ সাল) নভেম্বরে দেশের বাজারে রডের টন সর্বোচ্চ ৮১ হাজার টাকায় উঠেছিল, যা তখন ইতিহাসের রেকর্ড দাম ছিল। তার আগে ওয়ান/ইলেভেনের (২০০৭-০৮) সরকারের সময় প্রতি টন রডের দাম সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল।

গত বছরের নভেম্বরে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পর চলতি বছরের শুরুতে রডের দাম কিছুটা কমে টনপ্রতি ৭৬ হাজার টাকায় নেমে আসে। তবে জানুয়ারির শেষদিকে এসে আবার বাড়তে থাকে রডের দাম। ফলে জানুয়ারিতেই ফের ৮০ হাজার টাকায় উঠে প্রতি টন রডের দাম।

সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার পর রডের দাম বাড়ার পালে নতুন করে হাওয়া লাগে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। এরপর গত কয়েকদিনে দেশের বাজারে প্রতি টন রডের দাম সাত হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ৭ মার্চ ভালো মানের বা ৬০ গ্রেড এক টন রড কোম্পানিভেদে বিক্রি হচ্ছে ৮২-৮৮ হাজার টাকায়। কয়েকদিন আগে যা ৭৬-৮১ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছিল।

ব্যবসায়ীরা জানান, গত ১০ দিনে প্রায় প্রতিদিনই রডের দাম বেড়েছে। কখনো ৫০০, কখনো এক হাজার টাকা বেড়েছে। এভাবে এখন প্রতি টন রডের দাম ৮৮ হাজার টাকায় উঠেছে।

নির্মাণ সামগ্রীর অন্যতম প্রধান এই উপকরণটির দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বেড়েছে অনেক। এছাড়া ঘাটতিও দেখা দিয়েছে কাঁচামালের। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব পড়েছে।

দেশের ইতিহাসে রডের এমন দাম আর কখনো হয়নি জানিয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, যেভাবে কাঁচামালের দাম বাড়ছে এবং সংকট দেখা যাচ্ছে, তাতে সামনে আরও দাম বাড়তে পারে। এরই মধ্যে কাঁচামালের ঘাটতির কারণে কমে গেছে উৎপাদন।

এদিকে এভাবে দাম বাড়ার ফলে কোনো কোনো রড ব্যবসায়ী ক্রেতাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিচ্ছেন না। আবার ক্রেতারা দোকান থেকে রড কেনার সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ে যাওয়ার তাগাদা দিচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী।

ক্রেতা পরিচয়ে পুরান ঢাকার নওয়াব ইউসুফ রোডের মেসার্স ভান্ডার ট্রেডার্স গেলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মী মো. সোহেল বলেন, বিএসআরএমের রডের দাম ৮৮ হাজার টাকা, আর বন্দর কোম্পানির রড নিলে সাড়ে ৮৫ হাজার টাকা এবং একেএস রড নিলে সাড়ে ৮৬ হাজার টাকা পড়বে টন। এর নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়।

এখন কিনে ১৫ দিন পর ডেলিভারি নেওয়া যাবে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা সম্ভব নয়। আপনি ১৫ দিন পরই আসেন। কারণ কয়েকদিন ধরে রডের দাম বেড়েই চলছে। কিছুদিন আগে ৮০ হাজার টাকা বিক্রি হওয়া এক টন রডের দাম এখন ৮৮ হাজার টাকা হয়েছে। যেভাবে দাম বাড়ছে ১০-১৫ দিন পর রডের দাম এক লাখ টাকা হলেও আমরা অবাক হবো না। এরই মধ্যে দু-একটি কোম্পানি রড সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এর অর্থ হলো রডের দাম আরও বাড়বে। হয়তো আগামীকালই এক টন রডের দাম ৫০০-১০০০ টাকা বেড়ে যেতে পারে।

পুরান ঢাকার নিউ আকবর স্টিল হাউসের স্বত্বাধিকারী মো. আমির হোসেন দামের বিষয়ে বলেন, ভালো কোম্পানির মধ্যে এখন বন্দর স্টিলের রডের দাম কিছুটা কম। বন্দর স্টিলের রডের প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮৫ হাজার টাকা। সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বিএসআরএমের রড। এই ব্র্যান্ডের এক টন রড বিক্রি হচ্ছে ৮৮ হাজার টাকা। এছাড়া কেএসআরএম, একেএস, জিপিএইচের রড ৮৬-৮৭ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।

রডের দাম বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, যেভাবে রডের দাম বাড়ছে, তাতে আমরাও অবাক। দেখতে দেখতে রডের দাম টনপ্রতি ৭-৮ হাজার টাকা করে বেড়েছে। এখন রডের দাম বাড়ার কোনো হিসাব নেই। কী কারণে রডের এমন দাম বাড়ছে, তার সঠিক কারণ আমরা বলতে পারবো না। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ায় এমন হয়েছে বলে কোম্পানির লোকজন বলছে।

যোগাযোগ করা হলে কদমতলী স্টিল মিলস প্রাইভেট লিমিটেডের (কেএসএমএল) চেয়ারম্যান আজিজ আহমেদ বলেন, আমার জীবনে রডের এমন দাম আর দেখিনি। এটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। মূলত কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া এবং সরবরাহ কম থাকায় রডের এমন দাম বেড়েছে। এর পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব থাকতে পারে।

তিনি বলেন, কাঁচামালের মজুত কম থাকায় আমাদের উৎপাদন কমে গেছে। পরিস্থিতি এমন চলতে থাকলে রডের উৎপাদন সামনে কমে যেতে পারে। তখন কিন্তু দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দাম বাড়ার কারণে আমাদের রড বিক্রি অনেক কমে গেছে।

একই কথা বলেন বিএসআরএম স্টিলের কোম্পানি সচিব শেখর রঞ্জন কর। তিনি বলেন, মূলত স্ক্র্যাপের দাম বাড়ার কারণে রডের দাম বেড়েছে। ৭ মার্চ চট্টগ্রামে আমাদের রড বিক্রি হচ্ছে ৮৬ হাজার টাকা টন। ঢাকায় পরিবহন খরচ যুক্ত হয়ে এটা ৮৭-৮৮ হাজার টাকা হতে পারে।

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক আছে। রডের ঘাটতি নেই। তবে সামনে কাঁচামালের সোর্স যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। অবশ্য এখনো ওই পরিস্থিতি আসেনি।

আন্তর্জাতিক বাজারে এখন কাঁচামালের দাম বাড়লেও, এই পণ্য দেশের বাজারে আসতে তিন মাসের মতো সময় লাগতে পারে। তাহলে কাঁচামালের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে এখনই দেশের বাজারে রডের দাম বেড়ে যাওয়া কি উচিত? এমন প্রশ্নে বিএসআরএমের এই কর্মকর্তা বলেন, অবশ্যই উচিত। তিন মাস পর যদি এই মার্কেট না থাকে। তখন যদি স্থানীয় বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমরা কোথায় যাবো?

Share