মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার হওয়া শহীদদের স্মরণে চাঁদপুর বড়স্টেশনে মোলহেডে স্থাপিত স্মৃতিসৌধ নামফলকের যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় তরুণ প্রজন্মের প্রিয়ভাজন ‘নানা ভাই’।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এ স্থানটিকে চিহ্নিতকারী পাকা দেয়ালের নামফলকটি দীর্ঘদিন ধরে শেওলা পড়ে কালো বর্ণে রূপ নিয়েছিলো যাতে খোদাই করা লেখাটি একদম কাছে যাওয়া ছাড়া পড়ার সুযোগ ছিলো না। যা পাশের সৌন্দর্যমণ্ডিত স্মৃতিসৌধকে নির্দেশনাকারী হিসেবে খুবই বেমানােন ছিলো।
কিন্তু সবার চোখে বেমানানকে মানান সই করে দিলেন চাঁদপুরের সমাজসেবী লায়ন্স মাহমুদুল হাসান। তিনি গত ৩০ অক্টেবার বৃহস্পতিবার সেটিকে ব্যক্তিগত উদ্যেগে সাদা-কালো রং দিয়ৈ বর্ণিল করে দিয়েছেন। পরের দিন শুক্রবার ছুটির দিন পর্যটন স্পটে ঘুরতে বিষয়টি অনেকেরই নজরে পড়ে এবং এ কাজের জন্যে ‘নানা ভাইকে’ সাধুবাদ জানিয়ে নামফলকটির আগের ও বর্তমানের চিত্র সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তুলে ধরেন।
এ প্রসঙ্গে মি. মাহমুদ জানান ‘মহান মুক্তিযুদ্ধ এর শহীদদের স্মৃতি কে ধরে রাখার জন্য চাঁদপুর তিন নদীর মোহনায় নির্মিত হয় রক্তধারা স্মৃতি সৌধ’। প্রতিদিন দেশ বিদেশের হাজারো পর্যটকের পদচারণা ঘটে এই স্থানে। কিন্তু ” রক্তধারা ” লেখা এই সাইনবোর্ড টি ছিল বড় অবহেলা আর অযত্নে। যখনই সেখানে ঘুরতে যেতাম বন্ধুদের নিয়ে আমার ভীষণ খারাপ লাগত এই অযত্নে পড়ে থাকা ” রক্তধারা ” লেখাটি দেখে। অবশেষে আমি আমার ভালবাসা থেকে এই “রক্তধারা” লিখা স্মৃতি ফলক টি রং করিয়ে আমার মুক্তিযুদ্ধের শহীদ দের প্রতি ভালবাসার ইচ্ছে পুরন করলাম। শুকরিয়া পরম সৃষ্টি কর্তার নিকট।’
তাকে নানা ভাই হিসেবে তরুণরা কেনো সম্বোধন করে এমন প্রশ্নে তিনি জানান, ‘আসলে তরুণদের যে কোনো ভালো উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই এবং পাশে থাকার চেষ্টা করি। আর সে থেকেই তরুণরা আমাকে নানা ভাই সম্বোধন করেন। এটি তাদের ভালোবাসার একটি প্রতিদান বলতে পারেন।’
এ বিষয়ে চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী বলেন, ‘আমরা অনেক কথা বলে যাই, অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাই, অনেক অট্টালিকা গড়ে তুলি, নির্মাণ করি অনেক নান্দনিক স্থাপনা। কিন্তু নির্মাণশেষে কতো না চোখে পড়ার মতো জিনিসটাই অসমাপ্ত রেখে চলে যাই।” রক্তধারা”। আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, কৃষ্টি কালচারকে ধরে রাখতে চাঁদপুর বড় ষ্টেশন তিন নদীর মিলনস্থলে নির্মিত হয় এই স্থাপনা।
মি. পাটওয়ারী জানান, অপ্রিয় হলেও সত্য, ‘এ স্থাপনার পরিচয়টুকুর জন্য যে নাম ফলকটি তৈরি করা হয়েছিলো, তাতে রক্তধারার নামটি খচিত থাকলেও তা পড়ার কোন উপায় ছিলো না নির্মাণকাল শেষ হওয়ার পর থেকেই! এটি প্রশাসন, পৌরসভাসহ বহুজনের চোখে পড়লেও কেউ তা ঠিক করেনি। এর এই করুণ হাল দেখে বসে থাকতে পারলেন না, লায়ন মাহমুদ হাসান খান। এই প্রিয় মানুষটি সবার কাছে নানাভাই হিসাবে বহুল পরিচিত। তিনি নিজস্ব অর্থায়নে এই ফলকটির নান্দনিক রূপ তথা রক্তধারার মূল চেতনায় এটিকে রাঙিয়ে দিলেন। এই মহতী উদ্যোগের তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।’
প্রসঙ্গত, রক্তধারা স্মৃতিসৌধ হল চাঁদপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে তৈরি করা একটি স্থাপনা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চাঁদপুর জেলার পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায়, চাঁদপুর পুরাণ বাজার এবং চাঁদপুর বড় স্টেশনে কয়েকটি নির্যাতন কেন্দ্র বা টর্চার সেল তৈরি করে।
যেগুলোতে চাঁদপুর জেলার স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের উপর নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচার করা হতো। স্বাধীনতাকামী নারী পুরুষকে হাত-পা বেঁধে জীবন্ত ও মৃত মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর স্রোতে ফেলে দেয়া হতো। এই হত্যাযজ্ঞে যারা শহীদ হোন, তাদের স্মরণে চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক পিয়োতোষ সাহার উদ্যোগে ২০১১ সালে এটি নির্মাণ করা হয়।
এক স্তম্ভ বিশিষ্ট এ স্মৃতিসৌধে ৩টি রক্তের ফোঁটার প্রতিকৃতি দিয়ে বোঝানো হয়েছে রক্তের ধারা। টেরাকোটার মুর্যালে আঁকা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি ঘটনাবলীর চিত্র।
গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরে কবিতার ছন্দে এই স্মৃতিস্তম্ভে লেখা আছে-‘নরপশুদের হিংস্র থাবায় মৃত্যুকে তুচ্ছ করেছে যারা, এখানে ইতিহাস হয়ে আছে তাঁদের রক্তধারা। এ শুধুই স্মরণ নয়, নয় ঋণ পরিশোধ। এখানে অবনত শ্রদ্ধায়, নরপশুদের জানিও ঘৃণা আর ক্রোধ।’
পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মিলনস্থল ত্রিনদী মোহনার পাশাপাশি এমন একটি স্মৃতিস্তম্ভ থাকায় প্রতিদিন এখানে হাজারোা পর্যটকের ভিড় জমে। অনেকেই এ স্থানে নিজেকে সেলফিতে আবদ্ধ করেন। এর পাশেই রয়েছে ইলিশ ভাস্কর্য তথা ইলিশ সেলফি জোন। যা চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মন্ডলের উদ্যোগে তৈরি হয়।
প্রতিবেদক : দেলোয়ার হোসাইন, ৫ নভেম্বর ২০১৯