গেলো ০৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করলো প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এদিনই বর্তমান কমিশনের শেষ কর্মদিবস।
পেছনে ফিরলে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে এই কমিশন যতো না সুনাম কুড়িয়েছেন, তার চেয়ে বেশি কুড়িয়েছে ‘বদনাম’।
রকিব কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর এক-এগারো সরকারের সময় গঠিত এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের ধারাবাহিকতাই হয়তো রক্ষা করবে, এমনটিই ধারণা ছিলো সব মহলের। কিন্তু এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে ধারণাকে আমূল পাল্টে দিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর সাধারণ মানুষের ভরসা স্থাপন করতে ব্যর্থ হন তারা।
রকিব কমিশনের সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ ও জাবেদ আলী দায়িত্ব নেন ২০১২ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারি। আর নির্বাচন কমিশনার মো. শাহ নেওয়াজ দায়িত্ব নেন একই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। দায়িত্ব নেওয়ার পররপরই তারা দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু করেন। কিন্তু আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। এরপরই আসে ২০১৩ সালের ১৫ জুনের চার সিটি নির্বাচন। এই নির্বাচনে তেমন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। চার সিটিতেই জয়লাভ করেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।
দেশবাসীর মনে সন্দেহের সৃষ্টি হলেও আস্থা অটুট থাকে। এর মধ্যে বেশ কিছু উপ-নির্বাচন করেও বাহবা পায় রকিব কমিশন।
কিন্তু সব অর্জন ম্লান হতে শুরু করে এর কিছুদিন পরেই। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে ইসির ক্ষমতা কমানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেয় রকিব কমিশন। দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এরওপর গণমাধ্যমে আসতে থাকে একের পর এক প্রতিবেদন। সবকিছু বিবেচনায় পরবর্তীতে ইসির ক্ষমতা খর্ব করার সেই সংশোধনী আর আনতে পারেনি রকিব কমিশন। মূলত, তখনই স্পষ্ট হয় এই কমিশনের ভবিষ্যৎ!
এরপর আসে দশম সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও কিছু বিরল ঘটনার জন্ম দেয় রকিব কমিশন। ০৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করতে চাইলেও তাকে অসুস্থ বলে হাসপাতালে রাখা হয়। কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এরপর অনেক প্রার্থী মনোনয়নপত্র উইথ-ড্র করলেও তার মনোনয়নপত্র জমা বলে ধরা হয়। এছাড়াও নির্বাচনের ফল প্রকাশ করা হয় অনেক জায়গায় খুবই দেরিতে।
অভিযোগ ছিলো, রিটার্নিং কর্মকর্তারা অনেক জায়গায় ছয়-নয় করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জয়ী করতে সহায়তা করেছেন। এর ফল স্বরূপ ১৫৩ আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো না। ফলে ভোটগ্রহণ হয় মাত্র ১৪৭ আসনে। আর এতে পাঁচ কোটির বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগই পায়নি।
স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনে এতো সংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা নেই। এ নির্বাচনের পর দেশ ও দেশের বাইরে সব জায়গায় মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলে রকিব কমিশন।
দশম সংসদ নির্বাচনের পর আসে চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনেও ব্যাপক সহিংসতা আর কারচুপি হয়। নিহত হয় ৫০ এর বেশি মানুষ। সেসময় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, যে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন শোনেনি।
এরপর বড় নির্বাচন বলতে ২০১৫ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে আচরণ লঙ্ঘনের ছড়াছড়ি হলেও কোনো প্রকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি রকিব কমিশন। নির্বাচন কর্মকর্তারাও সরকার দলীয় প্রার্থীর অসদাচরণে মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন।
একই বছর ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম পৌরসভা নির্বাচন। এরপর ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হয় নবম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দলীয় ভিত্তিতে ওই দুই স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে পৌরসভা নির্বাচনে কমপক্ষে ১৭৭টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় লাভ করে। আর বিএনপি প্রার্থী ২২টি পৌরসভায় জয়লাভ করেন।
নবম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এবং পৌরসভা নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থী নির্বাচনের নজির বিহীন ঘটনা ঘটে। ওই নির্বাচনে দেড় শতাধিক মানুষ নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়। এছাড়া বিরোধী দলগুলোর প্রার্থীই কেবল নয়, সরকার দলের অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীও নিজ বাড়িতে অবস্থান নিতে পারেননি। কিন্তু এসব বিষয় রুখতে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিলো না নির্বাচন কমিশনের। ছয় ধাপে এই নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়। এতে নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা দুই হাজার ৬শ ৭২টি ইউপিতে জয়লাভ করে, বিএনপি পায় ৩শ ৭২টি এবং জাতীয় পার্টি ৫টি ইউপি। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৮শ ৮০টি ইউপিতে জয়লাভ করেন। এরমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচিত হন ২শ ১৫টি ইউপিতে।
এদিকে, সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই কেবল কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটেনি। এটিই রকিব কমিশনের অধীনে একমাত্র নির্বাচন, যেখানে কোনো প্রকার অনিয়ম হয়নি বলে গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রচার হয়েছে।
ইভিএম
এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম এর প্রচলন শুরু করে। পরিকল্পনা ছিলো, স্থানীয় সরকারগুলোতে এই মেশিনের পর্যাপ্ত ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা অর্জনের পর, ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করার। কিন্তু রকিব কমিশন জনপ্রিয়তা তো দূরের কথা ২০১৩ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া একটি ইভিএম ঠিক করতে পারেনি। ফলে তারা এই মেশিন বাদ দিয়ে নতুন ডিভিএম বা ডিজিটাল ভোটিং মেশিনের পরিকল্পনা রেখে গেছেন।
স্মার্টকার্ড
২০১১ সালে দেশের সব নাগরিকের হাতে উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড তুলে দেওয়ার জন্য আইডিইএ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিগত কমিশন। কিন্তু রকিব কমিশন এসে সেই প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় বাড়িয়েও দেশের মানুষকে স্মার্টকার্ড দিতে পারেনি। ঢাকার ৫০ লাখ ভোটারদের বর্তমানে সেই কার্ড বিতরণ করা হচ্ছে। প্রতিমাসে ১০ লাখ কার্ড বিতরণ হচ্ছে। এ গতি অব্যহত থাকলে দেশের নয় কোটি ভোটাদের হাতে কার্ড পৌঁছানোর কার্যক্রম শেষ করতে ৯০ মাস লাগবে। অর্থাৎ এ কাজ করতে সাত বছরের বেশি সময় লাগবে।
এছাড়াও জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের বিষয়টি এতো কঠিন করা হয়েছে যে, সাধারণ ভুল ঠিক করতেও এখন মাসের পর মাস ঘুরতে হয় নাগরিকদের। অথচ পাসপোর্ট সংশোধন করতে কোনো ভোগান্তি নেই। শুধু তাই নয়, এনআইডি প্রকল্প এখন ভোগান্তির অপর নাম আর দুর্নীতির আখড়া হয়েছে- খোদ ইসি কর্মকর্তারাই একথা বলেন। রকিব কমিশন এনআইডি প্রকল্পে মানুষের কষ্ট লাঘব তো দূরের কথা আরও ভোগান্তির জায়গা করে দিয়েছে।
সার্ভার স্টেশন
এটিএম শামসুল হুদার বিগত কমিশন তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সহযোগিতায় তহবিল সংগ্রহ করে, দেশের সব উপজেলায় সার্ভার স্টেশন প্রকল্প শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিলো, উপজেলায় যেহেতু ইসি কর্মকর্তাদের অফিস নেই, তাই অফিস করা এবং উপজেলায় বসেই এনআইডি পাওয়া সহজতর করা। আর এজন্য সার্ভার স্টেশনগুলোতে দেওয়ার কথা কানেক্টিভিটি। কিন্তু দুইবার দরপত্র আহ্বান করার পর তা বাতিল করে বর্তমান কমিশন। এখনও সার্ভার স্টেশন চালু হয়নি। ফলে নিজ এলাকাতেই সহজে জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার সহজ পথটিও আর সুগম হয়নি।
সংলাপ
এক-এগারো সরকারের সময়কার কমিশন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ করেই প্রায় সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু রকিব কমিশন একবার সংলাপ করেই সে পথ থেকে সরে এসেছিল। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিও সংশোধনের আগে মতামত নেওয়ার জন্য দলগুলোর সঙ্গে বসেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু সেসময় দলগুলোর করা কোনো প্রস্তাবই আমলে নেয়নি। নির্বাচন কমিশনের প্রধান ও একমাত্র সেবাগ্রহীতা হিসেবে দলগুলোকে বিবেচনা করা হলেও, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এদের আর ডাকেনি। ফলে দলগুলোর সঙ্গে কেবল দূরত্বই সৃষ্টি হয়েছে।
নিজস্ব ভবন
২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত আগারগাঁওয়ে স্থাপিত ইসি’র নিজস্ব ভবন প্রকল্পের মেয়াদ রয়েছে। এর এখনও কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু এরপরও কেবল নিজেরা বসবেন বলে তড়িঘড়ি করে কাজ অসমাপ্ত থাকতেই নিজস্ব ভবন উদ্বোধন করে বর্তমান কমিশন। এখনও বেশিভাগ কর্মকর্তার রুমে দাফতরিক কাজের উপকরণ সুবিধাগুলো সম্পন্ন করা হয়নি। এই ভবন উদ্বোধনের দিন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, দলগুলোর কোনো প্রতিনিধিকে দাওয়াত না দেওয়ায়। (বাংলানিউজ)
নিউজ ডেস্ক
।। আপডটে, বাংলাদশে সময় ১০ : ০০ এএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ বুধবার
ডিএইচ