সারাদেশ

যে কারণে মে মাসে বজ্রাঘাতে প্রাণহানি বেশি হয়

বছরের যেকোনও সময়ের চেয়ে মে মাসেই বজ্রাঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ২০১০-২০১৭ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে বজ্রাঘাতে মোট এক হাজার ৯৮৬ প্রাণহানির মধ্যে ৩২ শতাংশই ঘটেছে মে মাসে।

বজ্রপাত ও বজ্রাঘাতে মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম. এ. ফারুখ। তার গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

ড. ফারুখ বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বজ্রাঘাতের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এপ্রিলের শেষভাগ থেকে শুরু হয়ে মে মাসের তৃতীয়ার্ধ নাগাদ বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৫-৬ হাজার মিটার ওপরে আর্দ্র ও উষ্ণ বাতাস অবস্থান করে। এ কারণে মে মাসে অধিক বজ্রঝড় হয়ে থাকে।’ এ বছরের মে মাসে বজ্রঝড়সহ বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়বে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীবনযাপনে ধাতব বস্তুর ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং বজ্রপাত নিরোধক গাছের অভাবের কারণে মৃত্যুর হার বেড়েছে। তারা আরও বলেন, আগে কৃষিতে ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। কৃষকের কাছে বড়জোর কাস্তে থাকতো। কিন্তু এখন ট্রাক্টরসহ নানা কৃষি যন্ত্রাংশ ও মোবাইল ফোনের মতো ধাতব যন্ত্রপাতির ব্যবহার বেড়ে গেছে। এসব ধাতব বস্তুর ব্যবহার বজ্রপাতে বেশির ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করছে।

এ বিষয়ে ড. ফারুখ বলেন, ‘বিভিন্ন বছরের মে মাসের একইদিনে একাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বজ্রপাতে ২০১০ সালের ১৭ মে ৭ জন, ২০১১ সালের ২২-২৩ মে ৪৫ জন, ২০১২ সালের ২ মে ১৪ জন, ২০১৩ সালের ৫-৬ মে ৩২ জন, ২০১৪ সালের ৩০ মে ৮ জন, ২০১৫ সালে ১৬-১৭ মে ৩৩ জন, ২০১৬ সালের ১১-১২ মে ৫৭ জন, ২০১৭ সালের ৯ মে ২১ জন এবং এ বছরের ২ মে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।’

২০১৬ সালের ১১-১২ মে বজ্রাঘাতে ৫৭ জন মারা যাওয়ার পর সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। এর পরপরই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. এম.এ. ফারুখ তার বিভাগের মাস্টার্সের ৬ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে বজ্রপাতের বিষয়ে গবেষণা কাজ শুরু করেন। গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ড. এম. এ. ফারুখ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাপান, মঙ্গোলিয়া, আলাস্কা ও কানাডা থেকে বজ্রঝড় ও বজ্রপাতের ওপর যে জ্ঞান তিনি অর্জন করেছেন, তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কাজে লাগানোর জন্যই এ গবেষণা।’

তার এ সংক্রান্ত গবেষণায় মূলত দুটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এর একটি হচ্ছে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য, অন্যটি হচ্ছে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম জিআইএস। এই দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি ২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বজ্রপাতের কারণ, বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাসহ বছরওয়ারি প্রাণহানির তথ্য সংরক্ষণ করেন।

তার গবেষণা তথ্যমতে, বজ্রাঘাতে ২০১০ সালে মারা গেছে ১২৪ জন, ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে ৩০১ জন, ২০১৩ সালে ২৮৫ জন, ২০১৪ সালে ২১০ জন, ২০১৫ সালে ২৭৪ জন, ২০১৬ সালে ৩৫১ জন, ২০১৭ সালে ২৬২ জন ও ২০১৮ সালের মে মাসের ৪ তারিখ পর্যন্ত ৮৭ জন মারা গেছেন। এ হিসেবে ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের মে মাসের ৪ তারিখ পর্যন্ত বজ্রপাতে সারা দেশে মারা গেছেন দুই হাজার ৭৩ জন।

গবেষণায় দেশের বজ্রপাতের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাও চিহ্নিত করা হয়েছে। এ হিসেবে বজ্রপাতের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে রংপুর বিভাগে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও, রাজশাহী বিভাগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী সদর, ঢাকা বিভাগে কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম বিভাগে কক্সবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা বিভাগে সাতক্ষীরা, বরিশাল বিভাগে বরিশাল সদর, সিলেট বিভাগে সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার, ময়মনসিংহ বিভাগে নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ সদর।

কৃষক ও জেলেরাই বজ্রাঘাতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন দাবি করে ড. ফারুখ বলেন, ‘ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সতর্ক করা গেলে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর হার কমে আসবে।’ এ জন্য তিনি সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।

ড. এম. এ. ফারুখ ২০১১ সালে জাপানের হুক্কাই ইউনিভার্সিটি থেকে বজ্রপাত ও বজ্রঝড়ের ওপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন।

আন্তর্জাতিক ৪টি ও দেশের ৩৬টি জার্নালে তার বজ্রপাতবিষয়ক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এরমধ্যে যুক্তরাজ্যের জার্নাল অব ডিজাস্টার রিসার্চ ২০০৯ ও ২০১১ সালে এবং অ্যাটমসফেরিক সায়েন্স লেটারস ২০১৩ সালে একটি ও ২০১৪ সালে দুটি, জাপানের জার্নাল অব ন্যাচারাল ডিজাস্টার সায়েন্সে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে, আমেরিকার জার্নাল অব ক্লাই ম্যাথোলজিতে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

এছাড়া, বাংলাদেশের জার্নাল অব এনভায়রনমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্স, প্রগ্রেসিভ এগ্রিকালচারসহ ৩৬টি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

(বাংলা ট্রিবিউন)

Share