সিজারিয়ান হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোর বড় ব্যবসাক্ষেত্রে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রসূতি মা গেলেই তার পরিবারকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে অপারেশন করে শিশু জন্ম দেয়ার কথা। যাকে বলা হয় সিজারিয়ান। সন্তানের মায়েদের মনে বিষয়টি একটি প্রতিষ্ঠিত ধারণা বা অভিজ্ঞতা।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করলে মা এবং সন্তান দু’জনই পড়েন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন। কেননা মাকে এ সময় বিভিন্ন ধরনের চেতনা এবং বেদনানাশক ওষুধ দেয়া হয়। যার প্রভাব পড়ে মা এবং নবজাতকের ওপর।
অস্ত্রোপচারে গর্ভ নষ্টের ঝূঁকি বাড়ে, বাড়ে শিশুমৃত্যুর হার, মায়ের বুকের দুধ শুরু করাতেও সমস্যা হয়। আর অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের সঙ্গে অপরিণত শিশু জন্মেরও সম্পর্ক রয়েছে। যার ফলে শিশু প্রতিবন্ধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। । এ সব সত্ত্বেও দেশে স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা ব্যাপকহারে বেড়েছে।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে ২৩% বেশি সন্তান প্রসব হচ্ছে সিজারিয়ানে। তবে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে এ হার ৮০ %। প্রশ্ন হচ্ছে,এ ৮০% মায়ের অপারেশন কী মেডিক্যালে বর্ণিত ক্রাইটেরিয়াতে হয়? বিশেষ করে পরিবারগুলো যতো ধনী হচ্ছে, ততো বাড়ছে সিজারিয়ানের হার।
জাতীয় একটি দৈনিকের সাংবাদিক লাবণ্য লিপি সন্তান প্রসবের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘এখন নরমাল ডেলিভারি হয় আমি তো শুনি না। জোর করে কেটে-কুটে বের করে, কেন যে চিকিৎসকরা এটা করেন তাইতো বুঝি না।’
আমেরিকার মতো দেশেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসকরা অপারেশন ছাড়া কথাই বলেন না। ক্রিটিক্যাল কিছু না হলে সিজারের কথা আমেরিকানরা ভাবেন না, আর আমাদের একটা গরীব দেশে সুস্থ মানুষের পেট কেটে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা নেয়া হয়্। আমাদের দেশের চিকিৎসকদের পরিকল্পনাই থাকে অপারেশন করার। অথচ স্বাভাবিক প্রসবে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়।
লাবণ্য লিপি আরও বলেন,‘‘ আমার সময়ে নির্দিষ্ট দিনের ১৯ দিন আগে মেন্টাল ব্ল্যাকমেইল করে সিজার করানো হলো। আমার পরিচিত ডাক্তার ছিলেন। প্রথম থেকেই আমি তার চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমি একেবারে সুস্থ ছিলাম ও প্রেগনেন্সি ডায়াবেটিসসহ কোনও কমপ্লিকেশন আমার ছিল না। নিজের সুবিধামতো ডেট দিয়ে তিনি আমাকে মানসিকভাবে ব্ল্যাকমেইল করেন।’’
তিনি নিজেতো বটেই, তার সহকারীকে দিয়েও বলাতেন, কেন আপনি নরমাল ডেলিভারির জন্য অপেক্ষা করবেন, আপনি চাকরি করেন, জার্নি করেন, আপনার প্রয়োজনের সময় আমি কোথায় থাকি তারও ঠিক নেই, আপনিতো আমার কাছেই করবেন-তার চেয়ে আমি ডেট দিয়ে দিলাম-অপারেশন করে ফেলবো, এসব নানা কথা বলে তিনি আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতেন।
তিনি বলেন, নির্দিষ্ট তারিখের ১৯ দিন আগে তিনি অপারেশন করে বাচ্চাটাকে বের করলেন। অথচ আমার পরিবারেই একজন চিকিৎসক রয়েছেন তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম অপারেশনের বিষয়ে।
পরিবারের সদস্য বলেই তিনি আমাকে বলেছিলেন, ১৯ দিন বাচ্চাটা পেটে থাকলে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফ্যাট জমবে, আরও ম্যাচিউর হবে-এটা বাচ্চাটার জন্য ইতিবাচক, পরিবারের বড়রাও আমাকে নিষেধ করেছিলেন,কিন্তু চিকিৎসক আমাকে যেভাবে মটিভেট করেছেন সেখান থেকে আমি বেরুতে পারছিলাম না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বলেছেন, অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বেশি অর্থ পান, আর এতে হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোর লাভও হয় বেশি। কারণ, হাসপাতালে রোগী যত বেশিদিন থাকবে ততোদিনই ওষুধ খরচ থেকে শুরু করে,ওয়ার্ড বা কেবিন খরচসহ সব ধরনের খরচও বেশি হবে। স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হলে রোগীকে প্রায় এক সপ্তাহ বা কখনো কখনোও তারও বেশি থাকতে হয়।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪ থেকে জানা যায়,দেশের হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে ১০ জন শিশুর মধ্যে ৬ জন শিশুর জন্ম হয় সিজারিয়ানের মাধ্যমে। আর বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে এ হার ৮০ %। শিক্ষিত এবং স্বচ্ছল পরিবারে অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের প্রবণতা বেশি, প্রায় ৫০% শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।
অপরদিকে,দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে ৭% এবং ধনী শ্রেণির মধ্যে ৫০% পরিবারে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হচ্ছে। বিডিএইচএস আরও জানায়,২০০৪ সালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৪% শিশুর জন্ম হতো, ২০০৭ সালে ৯ %, ২০১১ সালে ১৭ % আর ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ %।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিন-২০১৫ তে দেখা যায়, দেশের উপজেলাগুলোতে সিজারিয়ানের মাধ্যমে শিশু জন্মের সংখ্যা প্রায় আটগুণ বেড়েছে। ২০১৩ সালে দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোতে সন্তান প্রসবের জন্য ১ লাখ ৬৬ হাজার ৭ শ’২১ জন প্রসূতি মা ভর্তি হন।
প্রসবের মধ্যে ৪৭ হাজার ৮শ’৬৮ ছিল স্বাভাবিক প্রসব,আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয় ১ লাখ ১৭ হাজার ১ শ’৬৪ জন শিশুর। ২০১৪ সালে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৪২ হাজার ৯শ’৫২ এবং অস্ত্রোপচার হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪৩ জনের। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন,১ শ’ প্রসূতির মধ্যে ৮০% জনেরই স্বাভাবিক প্রসব করানো যেত।
বিডিএইচএস’র মতে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৩৮% শিশুর জন্ম হয়। আর এনজিও পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে এই হার ২৮%। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে এই হার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ৮০% প্রসব হচ্ছে সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি রোগ বিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক রওশন আরা বেগম বলেন,আমাদের দেশে ৬২ % প্রসব এখনও বাড়িতে হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে শতভাগ প্রসবই সিজারিয়ানের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
ক্লিনিকগুলোতে ধনিক শ্রেণিরাই যায় বেশি। আর সেখানে তাদের চয়েসকেই প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। তিনি বলেন, একসময় এ হাসপাতালে সবই নরমাল ডেলিভারি হতো।
এখন প্রায় সবই হচ্ছে রোগীসহ তার পরিবারের সিদ্ধান্তে, সেখানে আমাদের কী করার আছে। আর বেশিরভাগ বেসরকারি ক্লিনিকের মালিক বসেই আছেন পয়সা উপার্জন করার জন্য, তারা রোগীদের নানাভাবেই মোটিভেট করে অপারেশন করার জন্য-এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৯:৩০ পিএম, ১৮ জুলাই ২০১৬, সোমবার
ডিএইচ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur