সারাদেশ

আফরোজার জুতা কেনা হলো না, পরিবার কিনছে কাফনের কাপড়

‘মা তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি এমবিএ-তে চান্স পেয়েছি। পাস করে বেরিয়ে বড় চাকরি করব। আমাদের অভাব থাকবে না।’

মাকে গত শুক্রবার বিকেলে এভাবেই বলছিলেন আফরোজা ইয়াসমিন—যিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ-তে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। গতকাল রবিবার তাঁর ভর্তির শেষ তারিখ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন, সে জন্য আফরোজা নতুন জুতা কিনতে বেরিয়েছিলেন শনিবার রাতে। একটি পিকআপ ভ্যান আফরোজার জীবন কেড়ে নেওয়ার পর পরিবার এখন তাঁর কাফনের কাপড় কিনছে।

মা নাসিমা বেগম জানান, তাঁর মেয়ে আফরোজা শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বাসা থেকে শ্যামপুর থানার পোস্তগোলার আলম মার্কেটের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাঁরা খবর পান পোস্তগোলায় বুড়িগঙ্গা ব্রিজের পাশে তাঁর মেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। আফরোজাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ১০টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

আফরোজা পরিবারের সঙ্গে শ্যামপুর থানার পশ্চিম জুরাইনের জয়নাল আবেদীন রোডের ৪৭/১ নম্বর নিজেদের সেমিপাকা বাড়িতে বসবাস করতেন। তাঁর বাবা মীর আকবর আলী প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। সুস্থ হলে ঘুরে ঘুরে সিরামিকের ব্যবসা করেন। আফরোজার ছোট বোন মৌসুমী অনার্সে পড়েন। ছোট ভাই ফয়সাল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে এবার। অভাবের সংসারে কিছুটা আর্থিক সহযোগিতার জন্য আফরোজা ২০১০ সালে এসএসসি পাস করার পর থেকেই টিউশনিতে নেমে যান। আইজি গেট এলাকায় একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতাও করতেন। সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন পড়ালেখা।

যে পরিবহনের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন আফরোজা, সেটিকে এখন পর্যন্ত চিহ্নিতই করা যায়নি। শ্যামপুর থানার ওসি মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোন গাড়ির ধাক্কায় মারা গেছে সেটা নিশ্চিত করে কেউ জানাতে পারছে না। তার পরিবারের লোকজন ধারণা করে বলছে পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয় আফরোজা।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা পরিবহন চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গতকাল সকালে আফরোজাদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, আফরোজার মা বিলাপ করতে করতে বলছেন, ‘আমার মা কই। আমারে রাইখা সে একলা একলা কেমনে থাকবো। আল্লাহ আমারেও লইয়া যাও।’ তাঁর কান্না দেখে উপস্থিত অনেকের চোখেও পানি দেখা যায়।

নাসিমা বেগম বলেন, ‘সে এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ-তে চান্স পাওয়ার পর থাইকা বেশ আনন্দে আছিল। সে প্রস্তুতি নেয় রোববার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হইবো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য সে এক জোড়া নতুন জুতো কিনতে চায়। এই কারণে শনিবার সন্ধ্যার পর বাড়ি থাইকা বের হয় আলম মার্কেটে যাওয়ার জন্য। আমারে কইয়া যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই জুতো কিনে বাড়ি ফিরবো আমার মা। কিন্তু সেই জুতা কিইনা আর সে বাড়ি আসে নাই। চইলা গেছে পরপারে।’

আফরোজার মামি লাভলী বেগম ও আফরোজার সহপাঠীরা জানান, আফরোজা মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। ২০১০ সালে ব্যাংক কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে মাধ্যমিক এবং ২০১২ সালে যাত্রাবাড়ীর মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর আফরোজা পুরান ঢাকার ফজলুল হক মহিলা কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে অনার্স করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ-তে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। গতকাল রবিবার তাঁর ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার কথা ছিল।

উপস্থিত প্রতিবেশীরা জানায়, বাসার খাওয়া, কাপড় চোপড়, ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশোনার খরচ সবই চলত আফরোজার টিউশনির টাকায়। আফরোজাদের বাড়িটি জুরাইন কবরস্থানের পাশেই। সেই কবরস্থানেই তাঁকে দাফন করা হবে বলে জানাল তাঁর আত্মীয়রা। (কালের কণ্ঠ)

বার্তা কক্ষ
৭ জানুয়ারি,২০১৯

Share