হাজীগঞ্জ

যেভাবে হাজীগঞ্জের ছেলেকে ঢাকায় হত্যার পর ‘ছিনতাইয়ের গল্প’ সাজানো হলো

ঢাকার ওয়ারিতে হাজীগঞ্জের এক ছেলেকে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যার পর ছিনতাইয়ের ‘গল্প সাজিয়ে’ লাশ হাসপাতালে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মালিকের বিরুদ্ধে।

ওয়ারি থানার এসআই আবদুল খালেক জানান, মঙ্গলবার মধ্যরাতে ওয়ারির ৭৩ নম্বর স্বামীবাগ এলাকায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিহত রিয়াদ হোসেন (২০) মতিঝিলের ‘ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ এ কাজ করতেন।

ওই রেস্তোরাঁর ম্যানেজার শফিককে আটক করা হয়েছে। রেস্তোরাঁ মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেলের (৩৩) খোঁজে অভিযান শুরু হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই রিপন হোসেন হোটেল মালিককে আসামি করে একটি হত্যা মামলাও দায়ের করেছেন বলে ওয়ারি থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জানিয়েছেন।

এসআই খালেক বলেন, “মোবাইল ফোন ও টাকা চুরির অভিযোগে রিয়াদের পা বেঁধে সোহেল নিজেই গুলি করেন বলে স্টাফরা জানিয়েছেন।”

অথচ মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে গুলিবিদ্ধ রিয়াদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে পুলিশকে বলা হয়, ছিনতাইকারীর গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন।

রিয়াদের এক সহকর্মীর বরাত দিয়ে হাসপাতাল ফাঁড়ি পুলিশের পরিদর্শক মোজাম্মেল হক বিষয়টি জানালে বুধবার সকালে গণমাধ্যমে খবরও আসে।

কিন্তু পরে রিয়াদের ভাই রিপন হোসেনের অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে এর সঙ্গে রেস্তোরাঁ মালিকের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। পুলিশও পরে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে।

নিহত রিয়াদ হোসেন ভাইয়ের বিবরণ
চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের মফিজুল ইসলামের ছেলে রিয়াদ সাড়ে তিন বছর আগে মতিঝিলের ঘরোয়া রেস্তোরাঁয় কাজ নেন। অন্য কর্মীদের সঙ্গে স্বামীবাগে হোটেল মালিক সোহেলের একটি নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকতেন তিনি।

রিয়াদের ভাই রিপনও এক সময় ঘরোয়ায় কাজ করতেন। এখন তিনি ফকিরাপুলের ‘ভাই ভাই হালিম সুইটস’ নামের আরেকটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন।

রিপন বলেন, মোবাইল ফোন ও ২১ শ’ টাকা চুরির অভিযোগে মালিকের লোকজন রিয়াদকে মারধর করছে খবর পেয়ে বুধবার রাতে ১২টার দিকে তিনি স্বামীবাগের ওই বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে দোতলায় ভাইয়ের চিৎকারও ‍শুনতে পান।

“অন্য স্টাফরা আমারে বলছে, ‘মালিক তারে মারতেছে। তুই যাইতে পারবি না।’ আমি বার বার ঢুকতে চাইছি। তখন আমারেও ধইরা নিতে চাইছে। একজন বলল- ‘তোরেও মারব, তুই চইলা যা।’ পরে ভয়ে আমি নিচে গিয়া দাঁড়ায় ছিলাম।”

রিপন বলছেন, কিছুক্ষণ পর ঘরোয়ার কয়েকজন কর্মীকে তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় রিয়াদকে বের করে নিয়ে যেতে দেখেন। তারা একটি গাড়িতে করে চলে যায়।

“পরে অন্যরা আমারে বলল, ‘মালিক তোর ভাইরে মুখের কাছে গুলি করছে, তাই হাসপাতালে নিয়া গেছে’।”

এরপর রিপন নিজেও ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যান। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ঘরোয়ার কর্মচারী জসিম, রাজু ও মালিক সোহেল হাসপাতালে এসে ছিনতাইকারীর গুলিতে রিয়াদের মৃত্যুর কথা বলে কেটে পড়েছে।

মতিঝিলের ‘ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ বুধবার সারাদিন বন্ধ দেখা যায় মতিঝিলের ‘ঘরোয়া হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’

‘ছিনতাইয়ের গল্প’
হাসপাতাল ফাঁড়ি পুলিশের পরিদর্শক মোজাম্মেল হক ভোর রাতে সাংবাদিকদের জানান, হোটেলের দুই লাখ বিশ হাজার টাকা নিয়ে গভীর রাতে মতিঝিল থেকে অটোরিকশায় করে শান্তিনগরে মালিকের বাসায় যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীরা গুলি করলে তা রিয়াদের মুখে লাগে বলে সহকর্মীরা তাদের জানিয়েছেন।

কিন্তু তারা যে ‘মিথ্যা’ বলেছে, তা পুলিশের কাছে স্পষ্ট হয় পরে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে খবর পেয়ে পুলিশ ভোর রাতে স্বামীবাগের ওই বাড়িতে যায় এবং সেখানে বসানো সিসিটিভির ছবি সংগ্রহ করে।

সেখান থেকে রক্তমাখা একটি কম্বল ও একটি কালো টি শার্টসহ কিছু আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে বলে পুলিশের ওয়ারি জোনের সহকারী কমিশনার মো. নুরুল আমীন জানান।

তিনি বলেন, “আমরা ফুটেজ দেখে অপরাধীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। শান্তিনগরে ঘরোয়া মালিক সোহেলের বাসাতেও খোঁজ নেওয়া হয়েছে। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

ওয়ারি থানার এসআই আবদুল খালেক জানান, গোলমালের খবর পেয়ে রাত ১টার দিকে পুলিশ গেলে হোটেল ম্যানেজার শফিক তাদের বলেন, টাকা ও মোবাইল চুরি করায় রিয়াদকে ‘সামান্য মারধর করা হয়েছে’। কিন্তু পরে হাসপাতাল থেকে তারা জানতে পারেন, ‘ছিনতাইকারীর গুলিতে’ রিয়াদ মারা গেছেন।

“শফিক আমাদের মিসগাইড করেছে। রাতে আমাকে সে গুলির কথা বলেনি।”

স্বামীবাগের বাড়িতে পাওয়া রক্তমাখা কাপড় 

স্বামীবাগের ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় টিনশেড যে ঘটে ঘরোয়াকর্মীরা থাকেন, সেখানে গিয়ে দুপুরে সবকিছু এলোমেলো অবস্থায় দেখা যায়। ঘরের একটি চৌকিও উল্টানো ছিল, মাটিতে ছড়ানো ছিটানো ছিল কাপড়চোপড়।

দ্বিতীয় তলার অন্যপাশে আরেকটি ঘরে বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগের মহানগর সভাপতি আবু হানিফ সেতুর কার্যালয়। ওই কার্যালয়ের সামনেই দেয়ালে বসানো আছে একটি ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা, যা দিয়ে ওই ভবনে যাওয়া-আসা পর্যবেক্ষণ করা যায়। আর ঘরের পেছন দিকে রয়েছে আরেকটি ক্যামেরা।

সেতু জানান, ‘নির্মাণাধীন ভবন’ বলে নিরাপত্তার স্বার্থে তারা ওই ক্যামেরা বসিয়েছেন। কার্যালয়ের ভেতরে ক্যামেরা মনিটর করার ব্যবস্থা রয়েছে। ভোরে পুলিশ এসে ওই ক্যামেরার ছবিই নিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, “পুলিশ ওই ভিডিও দেখার সময় আমিও ছিলাম। সেখানে দেখা যায় রাত ১২টা ৪৪ মিনিটে একটি কালো জিপ গাড়ি এই ভবনের সামনে আসে। সেখান থেকে সোহেল আর চারজনকে নামতে দেখা যায়। সোহেলের হাতি একটি লাঠিও ছিল।

“এরপর রাত ১টা ৭ মিনিটে কর্মীদের ঘর থেকে সোহেলকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। সে বার বার ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর চারপাঁচজন মিলে একটি ছেলেকে পাঁজাকোলা করে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়।”

রিয়াদের ভাই রিপন জানান, তাদের খালাতো ভাই মাইনুদ্দিন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। পুলিশ তাকেও থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

ময়নাতদন্ত

রিয়াদের লাশের ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কাজী আবু সামা।

ময়নাতদন্তের পর সন্ধ্যায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “রিয়াদের ঘাড়ের কাছে থেকে একটি গুলি পাওয়া গেছে। চোয়াল দিয়ে ঢুকে সেটি ঘাড়ের কাছে আটকে ছিল। সারা শরীরে জখমের চিহ্ন ছিল।”

আপডেট পড়ুন :

হাজীগঞ্জের রিয়াদ হত্যা : হোটেল মালিককে ধরতে বন্দরগুলোতে পুলিশের চিঠি

 

চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ১0:০৯ পিএম,২৯ অক্টোবর ২০১৫, বৃহস্পতিবার

এমআরআর

Share