যেভাবে বোকা বানায় পকেটমাররা

‎Saturday, ‎April ‎11, ‎2015    02:02:46 AM

চাঁদপুর টাইমস ডট কম : 

রাস্তায়, যানবাহনে, বাজারে, মেলায় অর্থাৎ লোকসমাগম স্থলে একটা সাধারণ আতঙ্ক হচ্ছে ‘পকেটমার’। এই হাতচালানি পেশাদারদের কবলে পড়েননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনো ঘটনা আছে যে, কোনো গৃহস্থ্য বা গৃহিণী রাস্তায় বেরিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ঘরে ফিরেছেন। এটা মানুষের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। ফলে বাইরে বের হলে পার্সটা পকেটটা সবাই সাবধানে রাখেন। তারপরও কেন দৈনিকই ঘটছে এমন ঘটনা। পকেটমাররা এতোটা দক্ষতা হাসিল করলো কীভাবে যে এতো সতর্কতার পরেও বোকা বানাচ্ছে তারা? এদের কৌশলটাই বা কী?

অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বলা যায়, হাত সাফাই তো আছেই, সাথে মানবমস্তিষ্কের দুর্বলতাকেই মূলত কাজে লাগায় পকেটমাররা। রাস্তায় হাঁটছেন। হঠাৎ এক ভদ্রলোক উপহার দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি অথবা মনোহারির দোকানদার সস্তায় আকর্ষণীয় জিনিস কম দামে গছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো। কিছু দূর গিয়ে হাতিয়ে দেখলেন পার্স বা পকেটে টাকা নেই। অথবা কোনো ভিখারিকে দেখে দয়া করে ২০ টাকা দিতে গেলেন কিন্তু সে অবাক করে দিয়ে ওতো টাকা না নিয়ে পাঁচ টাকার জন্য জিদ ধরলো। পার্স খুলে খুচরা টাকা বের করছেন আর ওই ফাঁকে সে দেখে নেবে কতো টাকা আপনার পকেটে। এরপর জায়গামতো সময় বুঝে হাত চালাবে। অথবা মসজিদ মাদরাসা এতিমখানার জন্য টাকা চাইতে এসেও আপনার মানিব্যাগটা চেক করে যেতে পারে।

এই ট্রিকসগুলোর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। মানুষ বা অন্য যেকোনো প্রাণীকে বোকা বানানোর মতো কিছু কৌশল আছে। এই দুর্বলতা মানুষের মস্তিষ্কের গঠনেই রয়ে গেছে। একে বলে ‘লুপহোল’ বা চোরাগলি। পকেটমার হওয়ার জন্য শুধু চতুর আঙ্গুল থাকলেই চলে না এই চোরাগলি সম্পর্কেও জানতে হয়।

মানুষের মস্তিষ্ক এক সাথে একাধিক কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। সেই সক্ষমতা তার নেই। আর এটাই জাদুকর বা পকেটমারদের মোক্ষম অস্ত্র! মঞ্চে যারা জাদু দেখান তারা এটাই করেন। হাত সাফাই মানে আসলে তা-ই। রঙিন পোশাক আর বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে দর্শকদের ব্যস্ত রাখে আর সুযোগ বুঝে হাত সাফাই করে জাদুকর। একে বলে ইলিউশন অব চয়েস। যেমন দ্রুত হাত চালানো। মানুষের মস্তিষ্ক .০১ সেকেন্ডের কম স্থায়ীত্ব সম্পন্ন কোনো চিত্র আলাদা করে শনাক্ত করতে পারে না। ফলে একটা ইলিউশন তৈরি হয়।

সাধারণত নির্জন রাস্তায় যা হয় :

হঠাৎ এক ভদ্রলোক হনহন করে এসে আপনার সামনে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন থেকে আরেক ভদ্রলোক আপনাকে ক্রস করতে গিয়ে তার সাথে ধাক্কা লাগলো। ব্যস শুরু হয়ে গেল বাকবিতণ্ডা। আপনি তো হতভম্ব। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। একটু পরেই দু’জন দু’দিকে চলে গেল পরস্পরকে গালাগাল করতে করতে। আপনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু বাঁচলেন না! বাস ভাড়া দিতে গিয়ে দেখলেন পকেট ফাঁকা। ক্যামনে হলো? ওই দুই লোকের গোণ্ডগোলের ফাঁকে তৃতীয় একজন আপনার পকেট মেরে দিয়েছে। সে আসলে ছিল তাদেরই লোক।

শিকার মাঝখানের জন, ‍দুই পাশে শিকারি
বাজারে, ফুটওভারব্রিজে, মেলা, গণপরিবহনে হঠাৎ অতিরিক্ত জনসমাগম হলে পকেট সাবধান! এখানে পকেটমার সিন্ডিকেট এ ধরনের জটলা তৈরি করে পকেট হাতিয়ে নিরাপদে সটকে পড়ে। অনেক সময় ধরা পড়লেও হঠাৎ এক ভদ্রলোক অতি উৎসাহী হয়ে আগ বাড়িয়ে ব্যাপারটা সমাধানের চেষ্টা করে। হয়ত পকেটমারকে চড় থাপ্পরও মারতে মারতে সরিয়ে নিয়ে যায়। সে কিন্তু ভদ্রলোক নয়, তাদেরই লোক। অথবা মেলায় বা পার্কে বা পার্টিতে অপরিচিত সুন্দরী ললনার সাথে গল্পে মজলে পকেট সাবধানে রাখবেন। পেছন থেকে কেউ মেরে দিয়ে যাবে। সেই ললনা কিন্তু একটা টোপ।

পকেট সাবধান! লেখা স্টিকার বা সাইনবোর্ডের নিচে পকেটমারদের সবসময় তীক্ষ্ণ নজরদারি থাকে। কারণ এসব সাইনবোর্ড দেখলে মানুষ অবচেতন মনেই পকেট হাতড়ে দেখে মানিব্যাগ, মোবাইল ঠিকঠাক আছে কি না।

কৌশল হতে পারে আরেকটি: কাছে আসবে একদম ভদ্রলোক বেশে। কোনো ধরনের সন্দেহ করতেও আপনার সঙ্কোচ হবে। পাশে বসে আড্ডা দেবে, আপনজনের মতো কথা বলবে। দূরযাত্রার বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে হতে পারে এটা। সুযোগ বুঝে ব্যাগ বা পকেট হাতাবে।

আরো দক্ষরা হিপনোটাইজ করে। আপনার কাছে দামি সুটকেস, ভারি ট্রাভেল ব্যাগ এসব দেখলেই কাছে এসে ভিড়বে। গল্প করবে, ভাব জমাবে। আপনার অজান্তেই এমন আস্থা অর্জন করবে যে তাকে বিশ্বাস না করে পারবেন না। এবার সুটকেস অথবা ব্যাগটা তার জিম্মায় দিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন নিশ্চিন্তে। ফিরে এসে দেখলেন সে সেই আপনার ব্যাগটাও নেই।

পানশালাগুলোর সামনে সুন্দরী নারীর ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন এমন ঘটনা আছে। মাতাল হয়ে হেলেদুলে হাঁটছেন। হঠাৎ এক সুন্দরী এসে গল্প জমিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। বুঝতে পারলেন না সে ল্যাং মারলো নাকি নেশার প্রভাব। এরপর দেখবেন সুন্দরীর সঙ্গে আরো কয়েকজন হা হা করে ছুটে আসছে আপনাকে সাহায্য করতে। সবাই মিলে ধরাধরি করে তুলে বাসায় দিয়ে এলো। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন নেশা কেটে গেল দেখলেন সব হাওয়া।

তবে বাজে ট্রিকস খাটায় আমাদের দেশের বেশিরভাগ পকেটমার। এরা বাজারে বা মেলায় কেনাকাটায় ব্যস্ত লোকদের পকেটে সুরসুর করে হাত ঢুকিয়ে সব বের করে আনে। অথবা ব্লেড দিয়ে পকেট বা ব্যাগ কাটে। বিশেষ করে ট্রেনে ব্লেড দিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ কাটার ঘটনা খুবই সাধারণ।

তবে সব ক্ষেত্রেই পকেটমাররা কিন্তু মস্তিষ্কের সেই লুপহোল বা চোরাগলিটাই ব্যবহার করে। দক্ষ পকেটমার হতে হলে ওই চোরাগলি সম্পর্কে ভালো করে জানতে হয়। তবে এ কথা সত্য যে, পকেটমাররা নিউরোসায়েন্স পড়ে এ ‘পেশায়’ নামে না। এদের বেশিরভাগই নিরক্ষর। অভিজ্ঞতাই তাদের এই গোপন অথচ বৈজ্ঞানিক কৌশলটা শিখিয়ে দেয়।

চাঁদপুর টাইমস : এমআরআর/2015

Share