আসন, মসনদ, সিংহাসন, গদি- এই শব্দগুলো শুনলেই চোখের সামনে প্রতীয়মান হয় মহাক্ষমতাধর কোনো শাসকের ছবি। ইতিহাস পরিক্রমায় শাসকের সংজ্ঞা, ধরন এবং ক্ষমতার পরিধি বদলালেও বদলায়নি এদের গুরুত্ব। মুকুটহীন রাজা যেমন বেমানান, তেমনি মসনদবিহীন সম্রাটও ঠিক রাজকীয়সুলভ নয়।
যদিও সরাসরি ক্ষমতার সাথে সংযোগ নেই, তবুও এই প্রতীকী আসন যেন শাসকের সকল ক্ষমতার শংসাপত্র। আর সেজন্যই ইতিহাসের পাতায় সাম্রাজ্যের পাশাপাশি মুঘলদের ময়ূর সিংহাসন, চীনের ড্রাগন সিংহাসন, ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটারের সিংহাসন, মহীশুরের সিংহাসনের নাম সমান গুরুত্বের সাথে উচ্চারিত হয়। কিন্তু এই সিংহাসন বা মসনদগুলো আদতে একেকটি ‘চেয়ার’ বা ‘কেদারা’ ব্যতীত আর কিছুই নয়। মানবসভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পরিচিত এই চেয়ারগুলো শুধু রাজ দরবারে নয়, বরং অফিস-আদালত, পাড়ার দোকান, সভা-সম্মেলনের মঞ্চ, শ্রেণিকক্ষ থেকে শুরু করে গৃহস্থালির প্রতিটি কক্ষে অপরিহার্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। নানান সংস্করণে নানান আকারে এসব চেয়ার আমাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করছে।
তবে এখানের আলোচনায় কোনো ময়ূর সিংহাসন বা গদি শোভা পাবে না। নিতান্তই সাধারণ এক চেয়ার। নাম হিসেবে বলা যায় ‘মনোব্লক’ চেয়ার। ঘরে-বাইরে দৈনন্দিন জীবনে একে আমরা প্লাস্টিকের চেয়ার বলে সম্বোধন করি। তবে এ কথা হলফ করে বলা যায়, রাজ-দরবারে অধিকার না পেলেও এই চেয়ারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়।
মনোব্লকের পূর্বসূরি পেন্টন
দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত প্লাস্টিক চেয়ারের মডেল নাম ‘মনোব্লক’ তা হয়তো অনেকের কাছেই নতুন তথ্য। মনোব্লক শব্দটি দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘মনো’ অর্থ এক এবং ‘ব্লক’ শব্দের অর্থ ছাঁচ। সাধারণত একটি ছাঁচ থেকে এই চেয়ার নির্মাণ করা হয় বলে এর নাম রাখা হয়েছে মনোব্লক চেয়ার।
অতি সাধারণ ও সরল ধরনের এই চেয়ারের কথা প্রথম কে ভেবেছিলেন তা সঠিকভাবে বলা যায় না। এমনকি এর আসল উদ্ভাবকের নাম নিয়েও নানা বিতর্ক রয়েছে। ১৯৪৬ সালে কানাডিয়ান নকশাকার ডগলাস সিম্পসন এমন একটি চেয়ারের নমুনা তৈরি করেন যা বর্তমান যুগের মনোব্লকের ন্যায় একটি ছাঁচের আদলে তৈরি। কিন্তু তখন এ ধরনের চেয়ার বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার মতো ঢালাই প্রযুক্তি ছিল না। ফলে তার চিন্তাপ্রসূত চেয়ার স্রেফ শিল্পের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে।
পেন্টন মডেলের মনোব্লক চেয়ার; Image Source: smow.com
৬০’এর দশকে এই দৃশ্যপটে পরিবর্তন আসলো। পরিবর্তন আনলো আরেক চেয়ার, যার মডেল নাম ‘পেন্টন’। ডেনিশ নকশাকার ভার্নার পেন্টন এই চেয়ারগুলো তৈরি করেন। ইংরেজি বর্ণ ‘S’ আকারের এই চেয়ারগুলো রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল এর সরলতা ও নান্দনিকতার বৈগুণ্যে। একে ইতিহাসের প্রথম নকশা করা প্লাস্টিক চেয়ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর তখন প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে এ ধরনের চেয়ার বাণিজ্যিক আকারে নির্মাণ করাও সম্ভব ছিল। এর ফলে শিল্পকর্মের গণ্ডি পেরিয়ে এটি আসবাবপত্র হিসেবে পরিচিত হলো।
পেন্টন মডেলের চেয়ারগুলো এখনও ভিট্রা নামক এক সুইস কোম্পানি উৎপাদন করে আসছে। পেন্টনের শিল্পকর্ম সংস্করণ নিউইয়র্ক, লন্ডন, বার্লিন এবং কোপেনহেগেনের জাদুঘরগুলোতে দেখা মিলবে।
আধুনিক মনোব্লক
মনোব্লক বিবর্তনের পরের ধাপে আসলো ‘ফ্যুতিল ৩০০’ মডেলের অত্যাধুনিক চেয়ার। এর নকশা করেন ফরাসি নকশাকার অঁরি মাসুনেঁ। তার উদ্দেশ্য ছিল সাদা প্ল্যাস্টিকের চেয়ারকে জীবনধারার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এই চেয়ারগুলো উৎপাদনে সাশ্রয়ী হলেও বাজারে প্রতিষ্ঠিত হতে এটির আরও কয়েক বছর লেগে যায়। ১৯৮৩ সালে বের হয় রেসিন গার্ডেন চেয়ার। এই মডেলের চেয়ারগুলো ক্রেতাদের নিকট সমাদৃত হয়। এর মাধ্যমে শুরু হয় মনোব্লক চেয়ারের বাজার জয়ের যাত্রা। (রোর বাংলা)