‘কওম’ আরবি শব্দ। এর অর্থ গোষ্ঠী, গোত্র, জাতি, সম্প্রদায় ও জনগণ। ‘কওমি’ শব্দের অর্থ জাতীয়। (বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ২০৫, ‘কওম’)।
‘মাদ্রাসা’ শব্দটিও আরবি। এর অর্থ হলো অধ্যয়নের স্থান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিদ্যাপীঠ।
বাংলা একাডেমির অভিধান মতে, মুসলমান ধর্ম ও সংস্কৃতিসংক্রান্ত উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রকে মাদ্রাসা বলা হয়। (ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পৃ. ৯৭৫, ‘মাদ্রাসা’)। সুতরাং কওমি মাদ্রাসা মানে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
যেহেতু কওমি মাদ্রাসাগুলো সরকারি অনুদানের পরিবর্তে মুসলিম জাতির অর্থানুকূল্যে জনসাধারণের কল্যাণে পরিচালিত হয়, তাই এই ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কওমি মাদ্রাসা বলা হয়।
মুসলমানরা চিরদিনই বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি অসীম গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। কারণ পৃথিবীর যত ধর্ম, দর্শন ও সভ্যতা আছে, তার মধ্যে ইসলামই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানচর্চার প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে।
যতই ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য হোক না কেন, প্রয়োজনে দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়েও জ্ঞানার্জন করতে হবে—এটা ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশ। মুসলিম জাতি অতীতে এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে।
তারাই একসময় জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে তমসাচ্ছন্ন ইউরোপকে শিক্ষাদীক্ষা ও জ্ঞানের জগতের সঙ্গে পরিচিত করেছে। এটি ঐতিহাসিক সত্য।
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত UNESCO-i Studies on Compulsory Education-এ উল্লেখ করা হয়েছে : ‘মুসলিম শাসনামলে শিক্ষা ও ধর্মকে অত্যন্ত অঙ্গাঙ্গিভাবে বিবেচনা করা হতো।’ সে আমলে মুসলিম পরিবারের শিশুদের শিক্ষা শুরু হতো পবিত্র কোরআনের শিক্ষার মাধ্যমে।
ইতিহাসবিদ এ আর মল্লিক লিখেছেন : ‘বাংলার মুসলমানদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখন কোনো সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হতো, তখন তার শিক্ষার সূচনা হতো। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শোনানো হতো। শিশু তা পুনরাবৃত্তি করত। এটা ছিল প্রতিটি মুসলিম পরিবারের অপরিহার্য প্রথা।’
(A. R. Mallic, British policy And Muslim in Bengal, p.149) ধর্মকেন্দ্রিক ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী ছিল, হান্টারের মূল্যায়ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন : “এ দেশটা আমাদের হুকুমতে আসার আগে মুসলমানরা শুধু শাসনের ব্যাপারেই নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল।
ভারতের যে প্রসিদ্ধ (ইংরেজ) রাষ্ট্রনেতা তাদের ভালোভাবে জানেন, তাঁর কথায় : ‘ভারতীয় মুসলমানদের এমন একটা শিক্ষাপ্রণালী ছিল, যেটা আমাদের আমদানি করা প্রণালীর চেয়ে নিম্ন হলেও কোনো ক্রমেই ঘৃণার যোগ্য ছিল না। তার দ্বারা উচ্চস্তরের জ্ঞান বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তি পরিচ্ছন্ন হতো। সেটা পুরনো ছাঁচের হলেও তার ভিত্তিমূল সুদৃঢ় ছিল এবং সেকালের অন্য সব (শিক্ষা) প্রণালীর চেয়ে নিঃসন্দেহে উত্কৃষ্ট ছিল। এই শিক্ষাব্যবস্থায়ই তারা মানসিক ও আর্থিক প্রাধান্য সহজেই অধিকার করেছিল।’ ’’ (সূত্র : উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, আবদুল মওদুদ অনূদিত, আহমদ পাবলিশিং হাউস, বাংলাবাজার, ঢাকা, পৃ. ১১৬)
সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। এই শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব পড়ে লর্ড মেকলের ওপর। সে শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ও ভবিষ্যৎ কী—এর বর্ণনাও পাওয়া যায় মেকলের জবানে। ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লর্ড মেকলে বলেন : ‘I have traveled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief, such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such caliber that I don’t think we would ever conquer this country unless we break the very backbone of this nation which is her spiritual and cultural heritage and therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their self-esteem, their native culture and they will become what we want them, a truly dominated nation.’ লর্ড মেকলের এই ভাষণ রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের Saving Humanity বইয়ের ১৬৯-১৭০ পৃষ্ঠায়।
ইংরেজদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য কী? ৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ সালে কলকাতার গভর্নর কাউন্সিলে লর্ড মেকলে বলেন, ‘…They Will be Indian in Blood and Color but Apprtite and thought Will be an European’ (woodrow, Macaulay’s Minutes on Education in India-1862 : Translated by Abdul Maudud.)—অর্থাৎ ‘ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের মাধ্যমে এই দেশে এমন একটি শ্রেণি গড়ে উঠতে হবে, যারা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসক ও শাসিতের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে।
এরা রক্ত-মাংসের গড়নে ও দৈহিক রঙে ভারতীয় হবে বটে; তবে রুচি, নীতিবোধ ও বুদ্ধির দিক থেকে হবে খাঁটি ইংরেজ।’ দারুল উলুম দেওবন্দ ও কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা শিল্প বিপ্লবোত্তর সময়ে যখন তাগুতি শক্তি কথিত উন্নয়ন, প্রগতি ও প্রযুক্তির মোহময়তার আবরণে সাম্রাজ্যবাদী দুরাকাঙ্ক্ষা পূরণে মত্ত হয়ে ওঠে, তখন তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে আসেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভি (রহ.)।
তিনি কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক বিধিবিধান বিশ্লেষণ করে পেশ করেন ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সার্বিক রূপরেখা।
পরবর্তী সময় বস্তুবাদের ফেতনা ভয়াবহ আকার ধারণ করলে পূর্বপুরুষদের যোগ্য উত্তরসূরি হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতভি (রহ.) নতুন রূপে, ভিন্ন আঙ্গিকে পথচলা শুরু করেন।
তিনি মূলনীতি অনুসরণ করে শাখা-প্রশাখায় সংযোজন করে একটি সমন্বিত শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেওবন্দ মাদ্রাসা। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেওবন্দের মহান মনীষীরা লর্ড মেকলের শিক্ষানীতিকে অসার প্রমাণ করতে চেয়েছেন। পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে চেয়েছেন।
তাঁরা চেয়েছেন এমন এক জাতি গঠন করতে, যারা রক্তে-বর্ণে হিন্দুস্তানি, কিন্তু চিন্তাচেতনা ও আদর্শে হেজাজি, মুহাম্মদি। ১৮৫৭ সালে ঐতিহাসিক সিপাহি বিপ্লব সংঘটিত হয়।
৩৪ জন শীর্ষস্থানীয় আলেম ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশদের প্রতিরোধের ডাক দেন। ব্রিটিশদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের স্বাধীনতাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন করে তাদের ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করেছেন কওমি মাদ্রাসার আলেমরা।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বালাকোটের ট্র্যাজেডির আগে সাড়ে ৫৭ হাজার (৫৭ হাজার ৫০০) আলেম শাহাদাতবরণ করেছেন। (সূত্র : গোলাম আহমাদ মোর্তজা, ইতিহাসের ইতিহাস, মুন্শী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ রিসার্চ একাডেমি, চতুর্থ সংস্করণ, জুলাই-২০০৯) আর বালাকোটের ট্র্যাজেডির পর আজাদি আন্দোলনের লড়াকু ১৪ হাজার আলেমকে ফাঁসি দেয় জালিম ইংরেজরা। (সূত্র : জিয়াউর রহমান ফারুকির ভাষণ, যাঁদের ত্যাগে এ দেশ পেলাম)
এটা ছিল এমন এক পরিস্থিতি, যার সঙ্গে তুলনা করা চলে হজরত আবু বকর (রা.)-এর সময়ে সংঘটিত ইয়ামামার যুদ্ধের সঙ্গে, যেখানে ৭০ জন কোরআনে হাফেজ শহীদ হলে অবশিষ্ট সাহাবার মধ্যে কোরআন সংকলন ও সংরক্ষণের জোর তাগিদ দেখা দেয়।
ঠিক তেমনি বিপুলসংখ্যক আলেম শহীদ হওয়ার ফলে দ্বীনের বেসিক বিষয়াদির হেফাজত করা অন্যতম ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের একটি রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে, পশ্চিমা শিক্ষা ও কালচারের আগ্রাসন থেকে মুসলিমদের বাঁচাতে কয়েকজন আলেমের উদ্যোগে ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের পশ্চিমা সভ্যতার আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখা ও ইসলামের হেফাজত করা। দেওবন্দ ছিল একটি প্রতিবাদ, একটি বিপ্লব, একটি আন্দোলন। ১৮৬৬ সালের ৩০ মে তদানীন্তন অখণ্ড ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দে হজরত কাসেম নানতুভি (রহ.)-এর নেতৃত্বে ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এটিই সর্বপ্রথম কওমি মাদ্রাসা।
এর ছয় মাস পর দারুল উলুমের আদর্শ ও পৃষ্ঠপোষকতায় সাহারানপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুজাহেরুল উলুম মাদ্রাসা’। তারপর দেওবন্দের কারিকুলামে বিভিন্ন দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়তে থাকে।
সে ধারাবাহিকতায় ১৯০১ সালে বাংলাদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৩৭ সালে আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ দেশে প্রায় ৪৪৩টি কওমি মাদ্রাসা ছিল।
এর মধ্যে প্রায় ৫১টি ছিল দাওরায়ে হাদিস মাদ্রাসা। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৫ সালের সালের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসা আছে।
সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। (প্রথম আলো : ২৯-০৯-২০১৬) অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতে, দেশে ২৬ থেকে ২৮ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। (দৈনিক কালের কণ্ঠ : ৮-৪-১৫) অধ্যাপক আবুল বারকাতের মতে, দেশে মোট ৫৫ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। (সূত্র : অধ্যাপক আবুল বারকাত, মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি, পৃ. ৯)
প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ছাড়াও কওমি কারিকুলামে মসজিদ, মক্তব ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক আরো লাখো প্রতিষ্ঠানে কওমি ধারার শিক্ষা দেওয়া হয়।
দেশের প্রতিটি জনপদে, শহর-বন্দরে, গ্রামগঞ্জে হাজারো মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপন করে মুসলমানদের জন্য ইমানি দুর্গ প্রতিষ্ঠা করেছে কওমি মাদ্রাসা।
এসব মসজিদ-মাদ্রাসায় এমন লাখো পরিবারের সন্তানদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সরকারি শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা যাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
এ অর্থে রাষ্ট্রের অপূরণীয় শূন্যতা পূরণ করছে কওমি মাদ্রাসা। কওমি মাদ্রাসা যত প্রত্যন্ত অঞ্চলেই অবস্থিত হোক না কেন, যত জীর্ণ, শীর্ণ ও সাদাসিধে হোক না কেন, মুসলিম সমাজে এসব মাদ্রাসার প্রভাব দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
এসব মাদ্রাসার বদৌলতে এখনো পৃথিবীতে কালেমার ধ্বনি শোনা যায়। ইমানের ডাকে অদৃশ্যের আহ্বানে মানুষ সাড়া দেয়। এ মাদ্রাসাগুলোর কারণেই এখনো পৃথিবীতে আল্লাহর আওয়াজ সমুন্নত আছে।
দ্বীনকে তার প্রকৃত রূপ, অবয়ব ও কাঠামোতে সংরক্ষিত রাখার দায়িত্বও কওমি মাদ্রাসা পালন করে আসছে।
(লেখক-আল আমিন আশরাফি, ইতিহাস গবেষক)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৩:৫০ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, শুক্রবার
ডিএইচ