জাতীয়

যেভাবে আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর। ইউনেস্কোর একটি উপদেষ্টা কমিটি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়,’মেমোরি অব দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এর তালিকায় এ ভাষণও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সারা বিশ্ব থেকে আসা প্রস্তাবগুলো দু’বছর ধরে পর্যালোচনার পর উপদেষ্টা কমিটি তাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত করে বলে ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বীকৃতির প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন-‘ইতিহাসের প্রতিশোধ’।

যে জায়গায় দাঁড়িয়ে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তার ভাষণের বৈশ্বিক স্বীকৃতি উদযাপনে সেখানেই সমাবেশ হয় ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর। সেই সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইতিহাস প্রতিশোধ নেয়। ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরে। যতই তা মোছার চেষ্টা হোক, ইতিহাস তার সত্য স্থানটা অবশ্যই করে নেবে। আজকে সেই স্বীকৃতি বাংলাদেশ পেয়েছে।’

বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা করে ইউনেস্কো। সংস্থাটি জানায়, তাদের মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড (এমওডব্লিউ) কর্মসূচির উপদেষ্টা কমিটি ৭ মার্চের ভাষণসহ মোট ৭৮টি দলিলকে ‘মেমোরি অফ দা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

প্যারিসে ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে সে বছরের ২৪ থেকে ২৭ অক্টোবর চার দিনের এক সভায় বসেছিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি (আইএসি)। সেখানে ইউনেস্কোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে নিবন্ধনের জন্য ৭৮টি দলিলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

আইএসির কমিটিতে ছিলেন ১৫ জন বিশেষজ্ঞ। চেয়ারম্যান ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ন্যাশনাল আর্কাইভের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আলরাইজি। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে নতুন করে প্রস্তাব করা ঐতিহাসিক দলিল পরীক্ষা ও মূল্যায়ন করেন।

দু’বছরের প্রক্রিয়া শেষে ২০১৬-১৭ সালের জন্য দলিলগুলোকে মনোনয়ন দেয়া হয়। মনোনয়নগুলো সম্পর্কে সুপারিশ করে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা বলেন, এ কর্মসূচি পরিচালিত হওয়া উচিত দালিলিক ঐতিহ্য ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য। যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সংলাপ,আন্তর্জাতিক সহযোগিতা,পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির চেতনা তাদের মনে লালন করতে পারে।

২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন শহীদুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শুরু থেকেই এ স্বীকৃতি অর্জন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির আবেদন করতে একটি নমিনেশন ফাইল তৈরি করতে হয়। এ নমিনেশন ফাইল তৈরিতে শহীদুল ইসলামকে সাহায্য করেছিলেন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।

এরপর এ ফাইলের যাচাই-বাছাই ও উন্নত করার জন্য তিনি আলাপ করেন তৎকালীন ডিএফপির ডিজি লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাথমিকভাবে যে ফাইলটা তৈরি করেছিল, তাতে শুধু তাদের কাছে থাকা ফর্টি ফাইভ আরপিএম রেকর্ডে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা দেওয়া হয়। প্যারিস মিশন খোঁজ করতে শুরু করে এ ভাষণের অন্যান্য দলিল।

বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ২০১৩ সালে ভাষণের একটি ডিজিটাল অডিও সংস্করণ তৈরি করে। আরও পরে ২০১৪ সালে তথ্য ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তৈরি করে একটি সংস্করণ। এর সবগুলোই ২০১৬ সালের ২৩ মে প্যারিস মিশন জমা দেয় ইউনেস্কোর কাছে। এরপর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়।

প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউনেস্কো ফেরত দিলো কিছু সংশোধনের জন্য। এরপর ১৭ এপ্রিল সংশোধনের পর আবার জমা দেয়া হয়। এরপর ইউনেস্কোর কমিটি ৩০ অক্টোবর ভাষণটিকে স্বীকৃতি দেয়।

Share