ফরিদগঞ্জ

‘যুদ্ধ করতে গিয়ে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, নিজের জন্য নয়’

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের আছৎকুয়ারী গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা সুবেদার(অব:) মো: শামছুল হক খান মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীরসেনানী। সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করেছেন। কখনো পিছপা হননি। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নিয়েছেন। পরে আবার এসে যুদ্ধে ঝাঁিপয়ে পড়েছেন। স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করতে গিয়ে নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারেন নি তিনি।

তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন করতে হবে এই একটা উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁিপয়ে পড়েছিলাম। তারজন্যই আজ আমার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ সম্মান জানাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেই স্মৃতি থেকেই বলছি, দেশকে ভালবাসুন। আপনি দেশের জন্য একটু কাজ করুণ। দেখবেন দেশ আপনাকে অনেক কিছু দিবে। যার উদহারণ আমরা মুক্তিযোদ্ধারা।

শামছুল হক খান ১৯৬৭ সালে তৎকালিন ইপিআর বাহিনীতে সৈনিক পদে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষনের পর সৈনিকদের মতো তিনিও অস্ত্র জমা না দিয়ে নিজের কাছে রাখেন। ২৫ মার্চ রাত ১০দিকে চট্টগ্রামের হালিশহরের ইপিআর ক্যাম্পে এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম রানারের মাধ্যমে আমাদের সাংবাদ দেন অফিসে আসার জন্য। তিনি, জে কিউ এম আব্দুল গফুর মন্ডল, হাবিলদার কোয়াটার মাস্টার মোতাহার, সেক্টর হাবিলদার , মেজর দেলোয়ার, সৈনিক মতিন, আব্দুর রাজ্জাকসহ অন্য বাঙ্গালিরা একত্রিত হন।

এরপর আমরা হালিশহরের চর্তুদিকে প্রতিরক্ষা গুহ তৈরি শুরু করেন। নিজ অবস্থানে থেকে রাতে অনবরত ফায়ার করেন। পরদিন সকালে নতুন পাড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু সৈনিক তাদের সাথে যোগ দেয়। একই সময় স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতারাও সহযোগিতা করেন।

৩১ মার্চ সকাল ৭টা থেকে পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সাথে যুদ্ধ চলে । কিন্তু যুদ্ধে তাদের সাথে না পারায় তারা হালিশহর সদর দপ্তর পাকবাহিনী দখল করে নেয়। ১ এপ্রিল তিনি মেজর জিয়ার নেতৃত্বাধীন কালুরঘাটে বাহিনীতে যোগদান করেন। ১১ এপ্রিল পাকিস্তানী বাহিনী আর্টিলারি, মর্টার, ট্যাংক, নৌ ও বিমান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আঘাত আনে।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছনে হটতে বাধ্য হয়। সেখান থেকে তিনি ১৩ এপ্রিল ফেনীতে চলে আসেন। ক্যাপ্টেন এনামুল হকের নেতৃত্বাধীন প্লাটুনে যোগ দেন। ফেনীর আওয়ামীলীগ নেতা খাজা আহাম্মদ তাদের সহযোগিতা করেন। শামছুল হক খানসহ মুক্তিযোদ্ধারা ফেনী পলিটেকনিক্যাল কলেজ, মুন্সীরহাটে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করলেও তাদের কাছে তেমন অস্ত্র না থাকায় পিছু হটতে বাধ্য হন। মে মাসের প্রথম দিকে ভারতের চোতরাখোলা হয়ে মেলাঘরে যান। সেখানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈনিকদের নিয়ে প্লাটুন তৈরি হলো। হাবিলদার আবুল কালামের নেতৃত্বে এই প্লাটুন পরিচালিত হয়। কিন্তু ভারী অস্ত্র না থাকায় তারা বারংবার যুদ্ধে গেলেও ফিরে আসতে হয়েছে। গীলাবাড়ি, সালদা, দেবপুর, খাজুরিয়া, ছাগলনাইয়া পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ফায়ার করে তারা ফিরে আসতো।

পরবর্তীতে ভারী অস্ত্র পাওয়ার পর থেকে তাদের মনোবল বেড়ে যায়। মেজর জাফর ইমাম মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানোর কাজ করেন। তারই নেতৃত্বে নভেম্বর মাসে আকন্দপুর গ্রামে প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাকবাহিনীর সাথে প্রচÐ যুদ্ধ হয়। পাকবাহিনীর বোমায় হাবিলদার কালামের এক পা ও ওবায়দুল এর মুখমÐলের একপাশ নষ্ট হয়ে যায়। ওই যুদ্ধে পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়ে। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আমরা রেজুপাড়া ব্রীজ এলাকা দখলে নেই।

মিত্রবাহিনী সাথে থাকায় শামছুল হক খানসহ মুক্তিযোদ্ধারা বেলুনিয়া, পরশুরাম, চিতলিয়া, মুন্সীরহাট, দেবপুর, খাজুরিয়া, ছাগলনাইয়া মুক্ত হয়। সর্বশেষ ১৩ ডিসেম্বর মেজর জাফর ইমাম এর নেতৃত্বে তারা ফেনী হয়ে চট্টগ্রামের কুমিরা পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অবস্থান নিয়ে মুক্ত করতে সমর্থ হন।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করে দেয়ার ঘটনাকে নিজেদের জন্য সেরা ঘটনা আখ্যা দিয়ে শামছুল হক খান বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করতে গিয়ে ফিরে আসবো ভাবিনি। সেদিন আমার সাথে অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। কিন্তু আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমি আজও বেঁচে রয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছিলাম। সেই যুদ্ধ শেষে আজ ৫০ বছর পর তারই সুযোগ্য কন্যা মননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এর চেয়ে গৌরবের আর কিছু নয়। যুদ্ধ করতে গিয়ে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। নিজের জন্য নয়। কিন্তু আজ আমাদের সেই স্মৃতিকে স্মরণ করে সরকার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিচ্ছেন, ঘরে করে দিচ্ছেন। সরকারি চাকুরিতে আমার প্রজন্ম সুবিধা পাচ্ছে। আর কী চাই।

প্রতিবেদক:শিমুল হাছান,২৩ মার্চ ২০২১

Share