Home / আন্তর্জাতিক / যুক্তরাষ্ট্রে আজ ভোট: কে হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট?
যুক্তরাষ্ট্রে আজ ভোট, গোটা বিশ্বের
ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রে আজ ভোট: কে হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট?

গোটা বিশ্বের দৃষ্টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে দেশটিতে আজ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে। পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে মঙ্গলবার স্থানীয় সময় ভোর ৬টায় (বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টায়) নির্বাচনে প্রথম ভোট পড়বে।

এবারের নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র এখন একটাই প্রশ্ন- কে হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট? রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জো বাইডেন? শেষ মুহূর্তে চলছে তারই চুলচেরা বিশ্লেষণ। নির্বাচনে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ভোটার প্রায় ৭০ শতাংশ। আর কৃষ্ণাঙ্গ ১১, হিসপ্যানিক ১১ ও এশিয়ানসহ অন্যান্য ৮ শতাংশ ভোট। সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে বাস করেন।

তারা প্রায় সবাই রক্ষণশীল মানসিকতার এবং রিপাবলিকান দলের সমর্থক। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ও শহরাঞ্চলে বসবাস করেন তাদের মধ্যে ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থক বেশি।

অপরদিকে সংখ্যালঘু কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপ্যানিক ও এশিয়ানসহ অভিবাসীদের সিংহভাগ ডেমোক্র্যাটকে সাধারণত ভোট দেয়। ২০০৮ ও ২০১২ সালে বারাক ওবামা সংখ্যালঘু ভোট পেলেও ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন তা পাননি। তাদের অনেকেই ভোট দিতে যাননি।

অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গরা সাধারণত ভোটদানে আগ্রহী না হলেও গত নির্বাচনে তারা ট্রাম্পের পক্ষে ভোট বিপ্লব ঘটিয়েছেন। ফলে সব জরিপের ধারণা ভেঙে দিয়ে ট্রাম্প জয়ী হন।

চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড, তার বেফাঁস মন্তব্য-কথাবার্তা এবং কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসীবিরোধী অবস্থানের কারণে সংখ্যালঘু ভোটাররা অনেকটাই তার বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। অন্যদিকে ট্রাম্পের আচরণের কারণে আগের মতো তার সমর্থনে নেই শ্বেতাঙ্গদের একটি অংশ। করোনা মহামারীতে ট্রাম্পের দায়িত্বহীন আচরণেও অনেক শ্বেতাঙ্গ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

তাদের মধ্যে নারী ও বয়স্ক ভোটাররাও ট্রাম্পকে পছন্দ করছেন না। তবে স্বল্প শিক্ষিত ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে তিনি এবারও রক্ষণশীল সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলো সামনে নিয়ে আসতে পেরেছেন। এ কারণে গ্রামাঞ্চলে ট্রাম্পের নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে বিপুলসংখ্যক লোকের উপস্থিতি চোখে পড়ে।

হিলারির তুলনায় বেশি সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ও হিসপ্যানিক জো বাইডেনের পক্ষে। এশিয়ানরা তো আছেনই। তরুণ শ্বেতাঙ্গ ভোটাররাও এবার বাইডেনের দিকে ঝুঁকেছেন। তবে বিপরীত চিত্রও আছে। এবার ভারতীয়দের একটি বড় অংশ এবং কিছুসংখ্যক বাংলাদেশি ভোটার ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন।

শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে একটি অংশ ট্রাম্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে কিংবা শ্বেতাঙ্গরা ভোট দিতে কম গেলে বাইডেনের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। আর এবার রেকর্ডসংখ্যক আগাম ভোটের যে হিসাব সে রকমভাবে ভোটের দিনও শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ভোট দিলে আগামী চার বছর ট্রাম্পের দখলেই থাকবে হোয়াইট হাউস। নিশ্চুপ (হিডেন) ভোটারদের ওপরই নির্ভর করছে ট্রাম্প-বাইডেনের জয়-পরাজয়।

নির্বাচন যে হাড্ডাহাড্ডি হবে তা বোঝা যাচ্ছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই প্রার্থীর নির্ঘুম প্রচারণায়। দুই প্রার্থী থেকে শুরু করে সমর্থকরা আছেন স্নায়ুচাপে। রোববার ও সোমবার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী প্রচারণা চালিয়েছেন দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে।

শেষদিনে দোদুল্যমান আটটি রাজ্য- ফ্লোরিডা, পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা, উইসকনসিন ও মিনেসোটায় জোর প্রচারণা চলে। এ রাজ্যগুলোর জরিপে এগিয়ে রয়েছেন বাইডেন। যদিও এ জরিপে আস্থা নেই অনেকের। জরিপে এগিয়ে থাকলেও ডেমোক্র্যাটিক শিবিরে শঙ্কা কাটছে না।

রোববার নর্থ ক্যারোলিনা ও মিশিগানসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে প্রচারণায় অংশ নেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনী রাতে বিজয় ঘোষণার পরিকল্পনা তার নেই। যদিও এর আগে তিনি বলেছিলেন, বাইডেন থেকে এগিয়ে থাকলেই তিনি বিজয় ঘোষণা করবেন। আর নির্বাচনের পর ব্যালট গণনার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন।

মিশিগানের সমাবেশ শেষ করে নর্থ ক্যারোলিনায় রওনা হওয়ার আগে বিমানবন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মনে করি, নির্বাচনের পরে ব্যালট গণনা করা হলে তা হবে খুবই ভয়াবহ। এটি অত্যন্ত ভয়াবহ বিষয় যখন নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও জনগণ বা রাজ্যগুলোকে ব্যালট গণনার সুযোগ দেয়া হয়। এটি আমাদের অজানা আশঙ্কার দিকে নিয়ে যেতে পারে।’

করোনার মধ্যে ডাকযোগে পাঠানো ব্যালটগুলো যেন নির্বাচনের পরও গণনা করা যায় এজন্য কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে অনুমতি দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট। ট্রাম্প তারই বিরোধিতা করে সুপ্রিমকোর্টের সমালোচনা করেন।

একইদিন নিজ জন্মস্থান পেনসিলভানিয়ায় প্রচারণা চালিয়েছেন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন। টেক্সাসে ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের রিপাবলিকানরা নাজেহাল করায় এবং ট্রাম্পের টুইটের কড়া সমালোচনা করেন বাইডেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শত শত বছরের ঐতিহ্য, সুনাম, রাজনৈতিক সৌন্দর্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নষ্ট করে দিয়েছেন।

বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা তিনি ক্ষুণ্ন করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘করোনা মহামারীতে ট্রাম্পের ব্যর্থতার কারণেই দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ৯০ লাখেরও বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ট্রাম্প সময়মতো ব্যবস্থা নিলে এত ক্ষতির শিকার হতে হতো না। ট্রাম্প করোনাকে পাত্তাই দেননি। নিজে মাস্ক পরেন না, মানুষকেও মাস্ক পরতে অনুৎসাহিত করেন।’

এদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক রিপোর্টে বলা হয়, বাইডেন জয়লাভ করলে শ্বেতাঙ্গবাদী ‘সুপ্রিমেসিস্টরা’ সংঘবদ্ধ হয়ে কৃষ্ণাঙ্গ, ইসপ্যানিক, ইহুদি এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা চালাতে পারে। আর ট্রাম্প জয়ী হলে ব্যাপক বিক্ষোভ গড়ে উঠতে পারে। বাইডেন সমর্থিত ‘এনটিফা’ বা ‘বিএলএম’ নেতৃত্বে গড়ে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সংঘাতেরও আশঙ্কা করা হয়েছে।

রেকর্ডসংখ্যক প্রায় সাড়ে ৯ কোটি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে, অনলাইন এবং ডাকযোগে এই আগাম ভোট দেয়া হয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যে মূল ভোটের দিন ভিড় এড়াতে বিপুলসংখ্যক ভোটার আগাম ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনী বিশ্লেষকদের ধারণা, আজ পাঁচ কোটি ভোটার ভোট দেবেন। এবার নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা প্রায় ২৪ কোটি ৫০ লাখ।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) প্রতিবেদন অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের জন্য প্রধানত শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থীরা দায়ী। এ বছর সন্ত্রাসী হামলার অধিকাংশ ঘটনা ঘটিয়েছে শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থীরা। এ বছরের প্রথম আট মাসে সংঘটিত ৬১টি সন্ত্রাসী ঘটনার ৪১টিই শ্বেতাঙ্গবাদীরা ঘটিয়েছে।

দল নিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত সিএসআইএসের তথ্য দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, শ্বেতাঙ্গবাদী উগ্রপন্থীদের সম্পর্কে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির পর্যালোচনা প্রকাশের দুই সপ্তাহ পর সিএসআইএসের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।

এতে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির উদ্বেগকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়। হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বার্ষিক পর্যালোচনায় শ্বেতাঙ্গবাদী উগ্রপন্থীদের তৎপরতা সম্পর্কে বলা হয়, ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টরাই এখন হোমল্যান্ডের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি এবং তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী হিসেবে সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে উঠেছে।’

সিএসআইএস’র থিঙ্কট্যাঙ্ক গবেষকরা জানিয়েছেন, এ বছরের সংঘাত ও সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো মোটামুটি গণবিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। তাদের রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ১২টি হামলার ঘটনার সঙ্গে কট্টর বামপন্থীরা জড়িত।

শতকরা হিসাবে এর হার ২০ শতাংশ। তারা বলছেন, কট্টর ডান ও কট্টর বামদের সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো গভীরভাবে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। কট্টর বামরা তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রায়ই বেছে নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সামরিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের এবং তাদের স্থাপনাগুলোকে।

সিএসআইএস’র রিপোর্টে বেশকিছু ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গুলি করে হত্যা, মিশিগান ও ভার্জিনিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নরকে অপহরণের চক্রান্ত এবং এই অভিযোগে এফবিআই’র হাতে ১৩ জনের গ্রেফতার প্রভৃতি।

এসবের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, বামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রকাশ্য ক্ষোভ, প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে উগ্র দক্ষিণপন্থী গ্রুপগুলোকে নিন্দা জ্ঞাপনে প্রেসিডেন্টের অস্বীকৃতি এবং এসবের কারণে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা।

সিএসআইএসের প্রতিবেদনে সহিংসতার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- দেশের উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, করোনাভাইরাস প্যানডেমিক এবং এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অচলাবস্থা। এছাড়া রাজনৈতিক মেরুকরণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান সংকট, বর্ণবিদ্বেষ ও বিচারহীনতা সন্ত্রাস বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কাজ করতে পারে।

শনিবার ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, টেক্সাসের হাইওয়েতে ট্রাম্পের পতাকাবাহী অনেকগুলো গাড়ি বাইডেনের সাইনযুক্ত একটি বাসকে ঘিরে রেখে নাজেহাল করছে। এ ঘটনাকে আরও উস্কে দিয়েছে ট্রাম্পের একটি টুইট।

কয়েক মিনিটের সেই ভিডিওর অংশবিশেষ টুইটারে পোস্ট করে তার ওপর ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আই লাভ টেক্সাস’। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের এ ঘটনার তদন্ত করছে গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই।

নিউইয়র্ক পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচনের দিন নগরীর ১২০০ ভোটকেন্দ্রে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতে সাড়া দেয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক পুলিশকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

এনওয়াইপিডির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, নিউইয়র্কে এখনও আশঙ্কাজনক কিছু ঘটেনি। তবে দেশের অন্যত্র যা ঘটছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে।

বার্তা কক্ষ,৩ নভেম্বর ২০২০