নিজের প্রয়োজনে আমাকে প্রতি মাসেই ঢাকা-চাঁদপুরে যাতায়াত করতে হয়। এক্ষেত্রে আমি নৌপথে যাতায়াত করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। এটা আরামদায়ক এবং আর্কষনীয়। এখন আগের চেয়ে সময়ও কম লাগে। ইদানিং নদীপথে তিন ঘন্টায় ঢাকা-চাঁদপুর যাতায়াত করা যায়।
নদীপথে যথেষ্ট বিনোদনও আছে,যা অন্য কোন গনপরিবহনে উপভোগ করা যায় না। তাই নৌযানে যাতায়াত সবার কাছেই এত আর্কষনীয়। এছাড়া লঞ্চগুলো ইদানিং বেশ আধুনিকায়ন করা হয়েছে। যথেষ্ট সংখ্যক কেবিন আছে।
অপরাপর শ্রেণিতেও অনেক বেশি উন্নয়ন হয়েছে। ফার্ষ্ট ক্লাস তো আছেই, নিচের তলার ডেকে অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণিতে অনেক লঞ্চে বসার বেশ ভালো চেয়ারের ব্যাবস্থাও রয়েছে। আরও আছে ক্যাফেটেরিয়ার সুব্যাবস্থা।
নদী পথে এটা খুবই আর্কষনীয় দিক। চপ, কাটলেট, তাৎক্ষনিক ভেজে দেয়া ডিম-পাউন্ডরুটির সেন্ডুইচ,বার্গার,রোল,গরম সিঙ্গারা ভাজা,নুডুল্স,চা-কফির ধোঁয়ায় সারাক্ষন মৌ মৌ করে নৌযানের ভাসমান ক্যাফেটেরিয়া। ভাত খাবারের ব্যাবস্থাও আছে। ১৫০/১২০ টাকায় প্যাকেজে বিক্রি হচ্ছে ডিম ভুনা-খিচুরি,মুরগি ভুনা-খিচুরি,মুরগি-ডাল ভাত,রুইমাছ-ডাল ভাত।
আরও আছে লেবু-তেল দিয়ে বানানো চানাচুর। ক্ষনে ক্ষনে ‘ঝাল দিয়া-লেবু দিয়া’ হাঁক ছেড়ে যায় মটর-ঘুগনীওয়ালা। বছরে বারোমাস মুন্সিগঞ্জ থেকে নৌকায় করে ফেরিওয়ালারা তাদের পন্য নিয়ে লঞ্চে উঠে। ছয়টা কলা দশ টাকা। পাঁচ টাকায় বিশেষ ধরনের বনরুটি। আরো আছে আপেল,কমলাসহ নানান মৌসুমী ফল ও সফ্ট ড্রিংস। মানে এ যেন এক বিচিত্র ভোজন মেলা। ক্ষুধা থাকুক বা না থাকুক,নৌযানের এই ভাসমান ক্যাফেটেরিয়ার লোভ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। খুব কম লোকই আছেন যারা নৌযানে চলাচল করেছেন কিন্তু ক্যাফেটেরিয়ার চা-কফি-খাবার উপভোগ করেন নাই। নেহাৎ বেরসিক ছাড়া এই লোভটা কেউ সংবরণ করতে পারেন না।
আমাদের অঞ্চলে নদীর জলের উপরে এরূপ খাবারকে ‘পরবাসী খাবার’ বলে। কিন্তু এই আর্কষনীয় পরবাসী খাবারই যে পরপারে যাবার যোগাযোগ ব্যাবস্থাটা সুগম করে রেখেছে তা কেন জানি আমাদের,বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেল। না,আমি কোন রোগ-বালাই ডায়রিয়া কিংবা খাবারের হাইজিন নিয়ে কথা বলছি না। আমি নদীপথে এক্সিডেন্টের কথা বলছি।
নৌযানের এই সকল প্রতিটি ক্যাফেটেরিয়াতে ভাসমান বোমা রয়েছে। একটু অবহেলা,একটু অসর্তকতায় ঘটতে পারে মহা বিস্ফোরণ। হ্যাঁ,এখনো ঘটেনি। এক্সিডেন্ট প্রতিদিন ঘটে না,এক মূর্হুতেই কেড়ে নিতে পারে হাজারো প্রান। নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো ছয়’শ থেকে হাজার যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। বিভিন্ন মৌসুমী ছুটি ও ঈদ-পূজা পার্বনে যাত্রী সংখ্যা আরো অনেকগুন বেড়ে যায়। তখন এমন দূর্ঘটনার সম্ভাবনা অনেক বেশি থেকে যায়।
নৌযানের প্রতিটি ক্যাফেটেরিয়ায় সিলিন্ডার গ্যাস ব্যাবহার করা হচ্ছে। আপাতত এর কোন বিকল্প নাই। তবে গ্যাস সিলিন্ডারগুলো যেভাবে যাত্রীদের পাশে রাখা থাকে তা সংঘাতিক বিপদের শতভাগ সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করে। এসব গ্যাস সিলিন্ডার আকারেও বেশ বড়। ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালকগন অনেকটা দায়সারাভাবে এসব গ্যাস সিরিন্ডারের সংযোগ দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে কাজ করছে। প্রয়োজনের জন্য আরও কিছু গ্যাস সিলিন্ডারও পাশাপাশি রাখা থাকে। যা দূর্ঘটনার সম্ভাবনাকে আরো বহু মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। অথচ এসব দেখবার জন্য কেউ নেই। এ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন প্রশাসনিক উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু এরূপ অব্যাবস্থাপনার কারনে দূর্ঘটনা ঘটলে এর দায় কে নিবে?
একেকটি যাত্রীবাহী লঞ্চ নির্মান করতে কয়েক কোটি টাকা খরচ করা হয়। অথচ যাত্রী সাধারণের জীবনের নিরাপত্তার এই দিকটি একদম অবহেলিত থেকে যায়। সারাক্ষণ এইসব যাত্রীবাহী লঞ্চের ক্যাফেটেরিয়ারে বেচা কেনা চলছে। চুলা জ্লছে। গ্যাস সিলিন্ডারের পাশেই যাত্রীরা দাঁড়িয়ে-বসে বিভিন্ন খাবার ও চা-কফি-সিগারেট খাচ্ছে। এখানে সব সময়েই যাত্রীদের বেশ ভির জমে থাকে।
এমন ভিরের মধ্যে গ্যাস সিলিন্ডারের বিষয়ে সাবধানতা রক্ষা করা মোটেই সম্ভব নয়। চাইলেই কোটি কোটি টাকায় তৈরী করা এসকল যাত্রীবাহী লঞ্চে গ্যাস সিলিন্ডার সংযোগের ব্যাবস্থাকে যাত্রী সাধারণের জীবনের নিরাপত্তার দিকটা নিশ্চিত করে করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন লঞ্চ মালিকদের সচেতনা। লঞ্চের ছাদে একটি বিশেষ জায়গায় এসব গ্যাস সিলিন্ডার রাখার ব্যাবস্থা করে পাকাপোক্তভাবে গ্যাস লাইন টেনে দিয়ে ক্যাফেটেরিয়ারের চুলায় সংযোগ দিলে গ্যাস বিস্ফোরণে দুর্ঘটনা ঘটলেও যাত্রী সাধারনের জীবনের ঝুঁকি একদম কমিয়ে আনা যায়। কোটি টাকায় লঞ্চ নির্মানের খরচের তুলনায় গ্যাস সিলিন্ডারের এমন সংযোগ ব্যাবস্থা করা কোন বিষয়ই না।
অথচ যুগ যুগ ধরে এভাবে যাত্রীবাহী লঞ্চের ভিতরে অপরিকল্পিতভাবে গ্যাস সিলিন্ডার সংযোগ রয়ে গেছে। ভাসমান ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে যাত্রী সাধারনের ভিরের মাঝে গ্যাস সিলিন্ডার বসিয়ে অস্থায়ীভাবে চুলায় সংযোগ রেখে চলছে আমাদের নৌপথে পরম আকর্ষনীয় ও আনন্দের পরবাসী খাবারের বিচিত্র মেলা। সুতরাং অতি দ্রুত যাত্রীবাহী লঞ্চের ভিতরে ভাসমান ক্যাফেটেরিয়াগুলোতে গ্যাস সিলিন্ডার সংযোগের অব্যাবস্থাপনা দূর করা একান্ত জরুরী।
লেখক:মইনুদ্দিন লিটন,চিত্রশিল্পী ও নাট্যকার