বহুমাত্রিক গুণে গুণান্বিত তেজী এক শব্দযোদ্ধা মিলন খান। যার ষষ্ঠ আঙুল সর্বদা মগ্ন থাকে সুন্দরের আরাধনায়- শব্দ বুনেন। একইসাথে অসুন্দরের মুখে শব্দবোমা ছুড়তেও সমান পারদর্শী তিনি। শিল্পাঙ্গনের যেকোনো অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে- উন্নতশির প্রতিবাদী এক কণ্ঠস্বর মিলন খান।
বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব মিলন খান একাধারে একজন কবি, গীতিকবি, কৃষিবিদ। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নদীবিধৌত ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। তিনি ৩১ মার্চের চাঁদপুর শহরের প্রফেসরপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আজিজ আহমেদ খান, মাতা আয়েশা বেগম। মেধাবী-কৃতী শিক্ষার্থী হিসেবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেবে বিএসসি (এজি) সম্মান এবং ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিংয়ে এমবিএ সম্পন্ন করেন।
ভিন্ন ধারার মৌলিক গানের নন্দিত গীতিকবি হিসেবে দেশজুড়ে খ্যাতির অনন্য উচ্চতায় থাকলেও মিলন খান তার পেশাগত জীবন শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে। তাঁর প্রথম কর্মজীবন ছিলো নিজের জন্মভূমি জেলা চাঁদপুরে আশেক আলী খান কলেজের প্রভাষক (১৯৯৫-৯৮) হিসেবে। এরপর মহা-ব্যবস্থাপক হিসেবে (২০০২-২০০৭) এটিএন বাংলা লিঃ এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান এটিএন মিউজিকে দায়িত্বরত ছিলেন। এছাড়াও শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ফ্যাকাল্টি বিজনেস ডিপার্টমেন্ট (২০০৮-১১) কর্মরত ছিলেন।
বাংলা সঙ্গীতের জনপ্রিয় এই গীতিকার আশির দশক থেকে শব্দসাধনা আর গান রচনায় নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। যিনি গানের কথা বুনেন ভালোবাসা আর আরাধনার গভীরতম জায়গা থেকে। এ কারনেই তাঁর গানে থাকে মানুষের কথা, থাকে প্রেম-বিরহ এবং সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার আহ্বান।
১৯৮৭ প্রথম লেখা গান ‘ময়না’। গেয়েছেন ব্যান্ড লিজেন্ড আইয়ুব বাচ্চু এবং ঐ গান আইয়ুব বাচ্চু’র ক্যারিয়ারে প্রথম সুপার হিট গান। তারপর দেশ বরণ্য প্রায় সব শিল্পীর জন্য মিলন খান লিখেছেন অসংখ্য জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল নন্দিত গান।
মিলন খানের ভাষ্যমতে, সহস্রাধিক গানের রচয়িতা তিনি। যা- অডিও, রেডিও, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রসহ সকল মাধ্যমে দেশবরেণ্য জনপ্রিয় শিল্পীদের কণ্ঠে গীত হয়েছে, হয়েছে সমাদৃতও।
পাশাপাশি শতাধিক কৃষিভিত্তিক গানের ডকুমেন্টারি ও কৃষি সেক্টরে মিউজিক্যাল মুভি নির্মাণ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
দেশের প্রায় সকল খ্যাতনামা ও নবীনদের সাথে কাজ করেছেন মিলন খান। মিলন খানের লেখা উল্লেখযোগ্য কিছু গান: সৈয়দ আব্দুল হাদির ভুল গাঙে, মেঘের পালকি, মিতালী মূখার্জীর কণ্ঠে ‘সেই যে তুমি চলে গেলে’, আইয়ুব বাচ্চু-শাকিলা জাফরের দ্বৈতকণ্ঠে ‘ঘড়ির কাঁটা থেমে যাক’, তপন চৌধুরীর কণ্ঠে ‘পাথর কালো রাত’, শুভ্রদেবের কণ্ঠে ‘এই সেই বুকের জমিন’, ডলি শায়ন্তনীর কণ্ঠে ‘নিতাইগঞ্জে জমছে মেলা’, সৈয়দ আব্দুল হাদীর কণ্ঠে ‘বড় কঠিন এ দুনিয়া’, রবি চৌধুরীর কণ্ঠে ‘সাদা কাফনে আমাকে জড়াতে পারবে’, এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে ‘ভুলে যাও বন্ধু’, আসিফ আকবরের কণ্ঠে ‘আমার স্বপ্নের নায়িকা তুমি’, মনির খানের কণ্ঠে ‘গতকাল ও জানতাম তুমি শুধু আমার’, এসডি রুবেলের কণ্ঠে ‘ফুলে ফুলে সাজিয়ে দিও আমার চতুর্দোলা’।
১৯৯৩ সালে শুভ্র দেব এর কন্ঠে গীত ‘বুকের জমিন’ গানটি শুনে স্বয়ং গানের ঈশ্বর পুলক বন্দোপাধ্যায় বলেন, ‘অসাধারণ গান, অসাধারণ গীতিকার মিলন খান’। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই স্বীকৃতিকেই নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে মনে করেন মিলন খান। মৌলিক কাব্যিক, শৈল্পিক নান্দনিক ধারার গীতিকবি মিলন খান কোনো পুরষ্কার, পদক কিংবা সম্মাননার ধার ধারেন না। বুকের ভিতর অভিমানের পাহাড় জমা করে- তিনি নিভৃতে সাজিয়ে চলছেন হাজারো গানের ডালি।
এ প্রসঙ্গে মিলন খান বলেন, বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে স্বদেশের সংস্কৃতিকে আপন মর্যাদায় উন্নীত করতে ‘গান রচনার’ মধ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমি জানি, এ কাজটা খুব সহজ নয়।
সহজ হত, যদি অন্যের গান থেকে এক লাইন, দুই লাইন ধার করে নিজের গানের বাণী সাজাতাম। সচেতন ও সমঝদার শ্রোতা খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, আমার গানের বানী ও ভাব সম্পূর্ণ মৌলিক। আমি ব্যক্তিসত্বায় যেমন স্বতন্ত্র্য, তেমনি আমার সংগীত সাধনায় সবার চেয়ে আলাদা।এটাই আমার স্বকীয়তা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ‘ঘাসফুল হয়ে কাছে থেকেছি নাকফুল করে নাওনি’ শিরোনামের কবিতা লিখে মিলন খান বেশ আলোড়ন তুলেন এবং উপাধী পান ‘ঘাসফুলের কবি’ হিসেবে। সেই স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে তিনি রচনা করেছেন একটি কবিতার বই। মিলনের খানের একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘জলের নগর’ পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়, যার প্রতিটি কবিতাই হৃদয়ছোঁয়া ও ব্যঞ্জনাময়।
দুই কন্যা লিয়ানা খান, অর্থোনা খান ও স্ত্রী লিপি খানকে নিয়ে রাজধানী ঢাকার বুকে তার গর্বিত সুখের সংসার। ৩১ মার্চ তার জন্মদিনে জানাই অনেক ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও অনেক অনেক দোয়া।
আশিক বিন রহিম
লেখক : কবি, গল্পকার ও সাংবাদিক