Home / নারী / মেয়েদের কোন্ গুণটি বেশি বিবেচনা প্রয়োজন
মেয়েদের কোন্ গুণটি বেশি বিবেচনা প্রয়োজন

মেয়েদের কোন্ গুণটি বেশি বিবেচনা প্রয়োজন

কামরুন নাহার রুমা | | আপডেট: ১০:৩৯ অপরাহ্ণ, ২২ আগস্ট ২০১৫, শনিবার

চুল আর পোশাক-আশাকের প্রতি বেশ মনোযোগী তিনি। একসময় মিস আমেরিকা প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছিলেন। কাজ করছিলেন আলাস্কার নির্বাচিত গভর্নর হিসেবে। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জন ম্যাককেইন রানিং মেট হিসেবে বেছে নিলেন তাঁকেই। অর্থাৎ রিপাবলিকান পার্টি জয়ী হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন সারাহ প্যালিন। কেউ তা মেনে নিলেন, কেউ এ সিদ্ধান্ত পছন্দ করলেন না। তবে না-মানাদের দলের বড় যুক্তি হলো, তিনি সাজগোজ, সৌন্দর্যচর্চায় এত মনোযোগী, কাজ করবেন কীভাবে। আরও জানা গেল, প্রচারণা চলাকালীন তাঁর পোশাক ও সাজে পার্টির খরচ হয়েছে ১৫ লাখ ডলার। ব্যস, সারাকে আক্রমণ করতে আর কি অস্ত্র দরকার! সারা জবাব দিলেন, কেন সব সময় নারী প্রার্থীদের পোশাক নিয়েই সমালোচনা হবে। কই, পুরুষ প্রার্থীরাও তো কম ফ্যাশনসচেতন নন, তাঁদের নিয়ে তো কথা হয় না।

সারার মতো কম বয়সী, অনভিজ্ঞ মানুষ কীভাবে মনোনয়ন পেলেন তা নিয়েও কত কথা। তাঁর আজকের অবস্থানের পেছনে দেখতে ভালো হওয়ার নাকি বিশাল অবদান। তবে এত কিছু বলার আগে কেউ ভেবে দেখল না, রিপাবলিকান পার্টি কি শুধু চেহারা দেখেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার মতো ঝুঁকি নেবে? তাঁর কোনো যোগ্যতা না থাকলে কি সত্যিই তিনি এত দূর আসতে পারতেন?

পশ্চিমা সমাজেই এমন পরিস্থিতি। আমাদের দেশে কী অবস্থা! কয়েকজন নারী পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এমন সমালোচনার মুখে তাঁরাও কম পড়েন না। মনের জোর নিয়ে এর পরও অনেক মেয়ে কাজ করে যান, কেউ আবার কাজ ছেড়ে দেন।

যে মেয়েটি ভালোভাবে পড়াশোনা করে শেষ করে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়জীবন, কাজে যোগ দিয়েও প্রমাণ রাখছেন দক্ষতার—তাঁর সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, শুধু তিনি দেখতে ভালো বলে! ‘ওহ, কীভাবে এত দূর এসেছে তা কি বুঝি না আমরা। চেহারাটা কাজে লাগিয়েই এত সাফল্য। পরীক্ষাতেই বা এত ভালো ফল করল কীভাবে। নিশ্চয়ই কোনো গডফাদার আছে, নইলে কি আর এত ভালো করতে পারে!’ এমন গুজব তো হবেই। গুজবের ডালপালা ছড়িয়ে সেটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এত কথা যে বলা হচ্ছে মেয়েটিকে নিয়ে, সত্যিই যে সে নিজের গ্ল্যামার কাজে লাগিয়েছে, তার প্রমাণ কী। কেউ কি তাঁকে দেখেছেন অন্যায় কোনো সুযোগ নিতে? তবে নিশ্চিত জবাব আসবে, না, দেখিনি বটে, তবে শুনেছি। আমাকে অমুক বলেছেন। অমুককে আবার তমুক বলেছেন। শুধু যে সহকর্মীরা বা পুরুষরাই এমন বলছেন তা কিন্তু নয়। ‘সহকর্মীরা বলেন। কিন্তু আমার মনে হয় মেয়েটির আত্মীয়স্বজনরাও অনেক সময় এ ধরনের গুজব ছড়ান। তথাকথিত বন্ধুরাও এসব বলেন।’ বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান ত্যাহনিয়াত আহমেদ করিম।

মেয়েরাও অন্য মেয়ে সম্পর্কে এমন গুজব ছড়াতে পারে দুটি ক্ষেত্রে। এক, তার নিজের জীবনটা হয়তো গণ্ডিবদ্ধ। তার নিজের আর এগোনোর কোনো সুযোগ নেই। সে অন্য মেয়েদের সাফল্য সহজভাবে নিতে পারে না। অথবা সে হয়তো জানেই না আজকের কর্মক্ষেত্রটা কেমন, কতটা কঠিনভাবে এখন সবার যোগ্যতার পরিমাপ করা হয়। সে বসে আছে পুরোনো ধ্যানধারণা নিয়েই। যোগ্যতা ছাড়া যে এখন কোনোভাবেই কিছু করা যায় না, এ বিষয়টি সে জানেই না। না বুঝেই সে অন্যের সম্পর্কে এমন কথা বলে। এমন মনে করেন ফারহানা এ রহমান। ইউওয়াই সিস্টেম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তিনি।

কেন এমন হয়? এর কারণ খুঁজতে চাইলে বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে স্বীকার করেন একটি বিষয়। ‘একটি মেয়ে শুধু নিজের যোগ্যতা দিয়ে সাফল্য পাবে, এই সত্যটি আমাদের সমাজ এখনো মেনে নিতে পারে না। মনে করা হয়, মেয়েরা কী আর বোঝে। যদি কোনো মেয়ে বুঝেও ফেলে, তাকে তখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ভয় পেতে শুরু করে। কারণ, তা হলে তো পুরুষদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে। যুগ যুগ ধরে পাওয়া তাদের বাড়তি সুবিধাগুলো খর্ব হবে।’ বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেলী খাদিজা আজাদ।

তিনি মনে করেন, একটি মেয়ে সবই করতে পারে। সে হয়তো পড়াশোনা করে সময়মতো আবার সাজগোজও করে। সব বিষয়েই যে সে সমান পারদর্শী হতে পারে, এটা সহজে মেনে নেওয়া যায় না। দেখতে ভালো, আবার কাজেও ভালো। নারীর এত গুণ কি সহজে মেনে নেওয়া যায়? নিশ্চয়ই তিনি তাঁর সৌন্দর্যের সুযোগ নিয়েছেন। শুরুতেই এখানে ধরে নেওয়া হয় মেয়েটি কিছু জানে না, পারে না। সৌন্দর্যই তাঁর শক্তি।

এই সময়ে জ্ঞান ও শক্তির নিয়ন্ত্রণ পুরুষের হাতে। নারীরও যে তাতে অংশ থাকতে পারে, এমন অনেকে ভাবে না। নারীর যোগ্যতার স্বীকৃতি সহজে দিতে চায় না অনেকেই। একটি মেয়েকে তাই প্রতি পদে অনেক বেশি যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে আসতে হয়।
‘একটি মেয়েকে এভাবে থামাতে পারলে, এই উদাহরণ ব্যবহার করে আরও অনেককেই দমিয়ে রাখা যাবে। এমনই মনে করে পুরুষেরা।’ বলেন ফারহানা এ রহমান।

তবে আজকের এই প্রতিযোগিতার সময়ে সত্যিই কি কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব শুধু সৌন্দর্য দিয়ে উচ্চপদে পৌঁছানো? ত্যাহনিয়াত আহমেদ করিম মনে করেন, একটি মেয়ে দেখতে ভালো, কথা বলে ভালো। কিন্তু দক্ষতা না থাকলে সে বেশি দূর এগোতে পারবে না। একটা পর্যায়ে তাকে থামতে হবেই।

ফারহানা এ রহমানের মতে, কেউ যদি অন্যায় কোনো সুবিধা নিতে থাকে, তার সহকর্মীরাই একটা পর্যায়ে তাকে থামিয়ে দেবে। এখন আর এটা কোনোভাবেই সম্ভব না যে কেউ কোনো যোগ্যতা ছাড়াই এগিয়ে যাবে। দেখতে ভালো হওয়াটা তো ভালোই। তবে এর সঙ্গে অন্য সব গুণ থাকলে তবেই সে এগোতে পারবে।

এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে একটি মেয়ে কী করতে পারে? হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকবে, না সব শক্তি দিয়ে লড়াই করবে? দুঃখজনক যে প্রথমটি অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটছে। কিন্তু হতাশ না হয়ে, নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে কাজ করে গেলে একটা সময় এমনিতেই এসব গুজব স্তিমিত হয়ে আসে বলে মনে করেন ত্যাহনিয়াত। আর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এসব গুজব হলে অবশ্যই মেয়েটির বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজ নেন। শুধু শোনা কথায় বিশ্বাস করে কোনো ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ আজকাল নেওয়া হয় না। কাজেই এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে কাজে মনোযোগ দেওয়াই ভালো বলে মনে করেন তিনি। এসব নিয়ে তাই প্রতিক্রিয়া দেখানোর কিছু নেই।

‘যে এমন কথা ছড়াচ্ছে তাকে একদম এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। তাকে দেখলে স্বাভাবিক ব্যবহার করুন। সে যেন বুঝতে না পারে যে তার কাজে আপনি খুব বিপর্যস্ত। তা হলেই আপনাকে পেয়ে বসবে। তাকে বাড়তি কোনো গুরুত্বই দেবেন না।’ বলেন ফারহানা এ রহমান।

তবে এখন সমাজ বদলাচ্ছে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাচ্ছে। একটা সময় কাজের বাইরের এসব বাড়তি ঝামেলা আর থাকবে না। ঘরে-বাইরে নানা গুজব, সমালোচনা আর সহ্য করতে হবে না। শুধু কাজেই মনোযোগ দিয়ে মেয়েরা এগিয়ে যাবে সমানতালে। এমন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে প্রয়োজন সবার সচেতনতা।

 

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫