বেশ অনেকদিন আগে, একটা লেখা লিখেছিলাম উচ্চতা নিয়ে। সেসময় সেই লেখাটি পড়ে এদেশের একজন প্রথিতযশা নারী আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানান। তারপর তার নিজের দুঃখের কথা খুলে বলেন। তিনি কিছুটা স্থূলকায়। ছোটবেলা থেকেই। সমস্যাটি হরমোনজনিত। এই স্থূলত্বের জন্য তাকে ঘরে-বাইরে প্রচুর গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। সহকর্মীরা প্রকাশ্যে এবং আড়ালে টিকাটিপ্পনি কাটে। রীতিমতো বুলিয়িং চলে। কোন কিছু খেতে গেলেই বাড়িতে শুনতে হয় ‘এত খেয়ো না’।
বান্ধবীরা প্রায়ই তাকে গায়ে পড়ে ডায়েটের ও ব্যায়ামের পরামর্শ দেয়। তার স্বামী নিজেও বেশ স্থূলকায়। কিন্তু তারপরও অন্যকোন ‘স্লিম ফিগারের মেয়ে’ দেখলে হা করে তাকিয়ে থাকেন এবং স্ত্রীর দিকে বিরক্তির দৃষ্টিপাত করেন। স্থূলত্বের কারণে তার কিন্তু অন্য কোন শারীরিক সমস্যা হচ্ছে না। তিনি বেশ উচ্চপদে একটি অফিসে চাকরি করেন, গুণেরও শেষ নেই। তবু সব গুণ ছাপিয়ে তার ‘প্রথম পরিচয়’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘ওই মোটা মেয়েটা’।
‘অনেকে বলবেন মোটা পুরুষকেও বিরুপ মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়। স্বীকার করছি তা হয়। তবে নারীর বিরুদ্ধে এই মন্তব্যগুলো ছুঁড়ে দেওয়ার পরিমাণ অনেক বেশি। এমনকি বিয়ের সময় স্থূলকায় মেয়ের পাত্র পাওয়াই অনেক সময় মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।’
আরেকটি ঘটনা বলি। কিছুদিন আগে ফেসবুকে এক ভদ্রলোকের একটি ছবি দেখলাম। তিনি সফরে যাচ্ছেন। সেলফি দিয়েছেন। পিছনে তার সফরসঙ্গীদের দেখা যাচ্ছে। সফরসঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন বেশ বিখ্যাত এক নারী। তিনিও গুণবতী। ইদানিং একটু মুটিয়ে গেছেন। ভদ্রলোকের ছবির নিচে তার জনৈক বন্ধু কমেন্ট করেছে, ‘পিছনে ওই মোটা জিনিসটা কি?’ এই কমেন্ট যে লোকটি করেছে সে নিজেও এমন কিছু অ্যাপোলো নয়। তবু একজন গুণী নারী সম্পর্কে এই বাজে মন্তব্যটি করতে তার বাধেনি।
আমার এক পরিচিত নারী আছেন। যথেষ্ট সুন্দরী ও গুণবতী। কিন্তু তাকে দেখলেই আত্মীয়-স্বজনের প্রথম কথা হলো ‘এত মোটা হয়ে গেছ!’ আমার ইচ্ছা করে বলি ‘হ্যাঁ ও মোটা হয়েছে, তাতে তোমার সমস্যা কি? তোমার টাকায় খেয়ে তো মোটা হয়নি।’ কেন গায়ে পড়ে তাকে অযাচিত উপদেশ দেওয়া, কেনই বা তার স্থূলত্ব নিয়ে টিকাটিপ্পনি? তার তো অনেক গুণ আছে, আরও অনেক বৈশিষ্ট্য আছে। সেগুলো নিয়ে কি কথা বলা চলে না? তাকে দেখলেই ‘সে মোটা’ একথাটাই প্রথম মাথায় আসে?
শুধু যে স্থূলকায় নারী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য শোনা যায় তা নয়। কৃশকায় নারীকে নিয়েও টিকাটিপ্পনির অভাব নেই। মোটকথা নারীকে হতে হবে কারিনা কাপুরের মতো জিরো ফিগারের এবং আদর্শ ফিগারের। তার গুণ যতই থাকুক না কেন, দিনের শেষে তার শরীরই শেষ বিবেচ্য। কিন্তু এই আইডিয়াল ফিগার বিষয়টি স্থির করা গেল কিভাবে? প্রাচীন গ্রেকো-রোমান ভাস্কর্যগুলো দেখলে দেখা যায় আফ্রোদিতি বা ভিনাস এবং অন্য দেবীরাও একালের ক্যাটাগরিতে একটু মোটাই বটে। অন্তত একালের তথাকথিত জিরো ফিগারের অধিকারী তো তারা মোটেই নন।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত পেইন্টিংগুলোর দিকে তাকানো যাক। সেখানেও নারীর যে দেহ আঁকা হয়েছে তা সুস্বাস্থ্য সমৃদ্ধ। একালের মাপকাঠিতে তারা মোটা। অবশ্য ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই শুরু হয় অতিরিক্ত কৃশ কোমরের চল। ইউরোপে ও আমেরিকায় লোহার জালের তৈরি কর্সেট পরে নারী নিজের কোমরকে সরু রাখার সাধনায় ব্যাপৃত থাকতো। বলা হতো কোমরটি এমন হওয়া চাই যেন একজন পুরুষ দু’হাতের মুঠোয় তা ধরতে পারে।
প্রশ্ন উঠতে পারে নারীর সৌন্দর্য চেতনার মূল উদ্দেশ্য কি পুরুষের মনোরঞ্জন? তা তো নয়। তা হওয়া উচিতও নয়। কে বলেছে তাকে সুস্তনী, গুরুনিতম্বিনী, মেদহীন হতেই হবে? এই মাপকাঠি কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্থির করে দেওয়া নয়? একজন মানুষের সৌন্দর্য তো নির্ভর করে তার কর্মক্ষমতা, মানসিকতা, শিক্ষাদীক্ষা, আচরণের উপর। কোনভাবেই শরীরের মাপে নয়।
এ কথা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অনেকে বলবেন মোটা পুরুষকেও বিরুপ মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়। স্বীকার করছি তা হয়। তবে নারীর বিরুদ্ধে এই মন্তব্যগুলো ছুঁড়ে দেওয়ার পরিমাণ অনেক বেশি। এমনকি বিয়ের সময় স্থূলকায় মেয়ের পাত্র পাওয়াই অনেক সময় মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। ‘মেয়ের মা মোটা’ এই অজুহাতে আমার পরিচিত এক মেয়েকে দেখতে আসা পাত্রপক্ষ মোটা যৌতুক দাবি করেছিল বলে শুনেছি। নারীকে তার দৈহিক রূপ দিয়ে মাপার যে অপচেষ্টা করা হয় তারই শিকার হন স্থূলকায় নারীরা।
ফিরে আসি ‘মোটা মেয়ের’ কথায়। সৌন্দর্যের মূল বিবেচ্য হওয়া দরকার স্বাস্থ্য ও সুস্থতা। কারও যদি স্বাস্থ্য ভালো থাকে, তিনি যদি সুস্থ হন, কর্মক্ষম হন তাহলে কে একটু মোটা কে একটু রোগা তা নিয়ে অপরের মাথাব্যথার কোন প্রয়োজন তো নেই। ফ্রান্সে সম্প্রতি একটি আইন পাশ হয়েছে। আইনটি হলো সৌন্দর্যের নামে র্যাম্প মডেলদের অস্বাস্থ্যকরভাবে রোগা বা কৃশকায় করে ফেলা চলবে না। কারণ রোগা থাকতে গিয়ে বা মডেলিং জগতে টিকে থাকতে গিয়ে মডেলরা এতই কৃশকায় হয়ে যাচ্ছেন যা তাদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
তারা দিনের পর দিন অত্যন্ত কম খাচ্ছেন। তাদের পুষ্টির ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এইভাবে স্লিম থাকার সাধনায় না খেয়ে থেকে একবার মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন লেডি ডায়না। ঘটনাটি স্মরণ থাকতে পারে অনেকেরই। অতিরিক্ত স্থূলতা বা অতিরিক্ত কৃশতা অনেক রকম শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। সেজন্য অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু সুস্থ ও কর্মক্ষম মানুষের একটু মোটা বা রোগায় কি আসে যায়? (উৎস- জাগো নিউজ)
লেখক : শান্তা মারি, কবি, সাংবাদিক।