মৃত স্বামীকে নিয়ে যা বললেন তসলিমা

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। কবি ও গীতিকার। ‘প্রতিবাদী-রোমান্টিক’ হিসেবেই তার খ্যাতি। আজ এই কবির জন্মদিন। ১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জে তার জন্ম। মাত্র ৩৪ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের জীবনে এত প্রাণ, এত উদ্দামতা, এত গতিময়তা, এত দ্রোহ আর দেখা যায়নি।

রুদ্রর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গায়ক কবীর সুমন লিখেছিলেন: ‘… তিনি (রুদ্র) ছিলেন এক বেপরোয়া বোহেমিয়ান। নানা কৃত্রিমতা ও ভণ্ডামিতে ভরা আমাদের নাগরিক সমাজের লোক নন। প্রকৃত আর্টিস্টের মতোই তিনি ছটফটে, অধৈর্য, বেহিসেবি, বাউণ্ডুলে, নিজের আখের না-গোছাতে চাওয়া,নিজের সম্পর্কে যত্নবান হওয়ার ইচ্ছে পোষণ না করা দামাল। তার লেখা পড়ে মনে হয়েছিল কোনো নিয়মে বা রীতি-নীতিতে তিনি বাঁধা থাকার পাত্র নন। তিনি শুধু লেখায় নয়, যাপনে বিশ্বাসী। তার লেখা মনে হয়েছিল, যাপন-ভিত্তিক। সে যাপন অনেকেরই পছন্দ হবে না। তাতে তার কিছু যেত আসত বলে আমার অন্তত মনে হয় না।’

কবীর সুমন যথার্থ বলেছেন। রুদ্রের সঙ্গে লেখিকা তসলিমা নাসরিনের প্রেম ও বিবাহিত জীবনের কথা পাঠকের অজানা নয়। সে কথার কিছু অংশ তসলিমা নাসরিনের নির্বাচিত কলাম থেকেই তুলে ধরছি কবির জন্মদিনে।‘রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা’য় তসলিমা নাসরিন লিখেছেন: ‘এ কথা আমি বিশ্বাস করি না যে রুদ্র নেই। রুদ্র মোংলা বন্দরে নেই, রাজাবাজারে নেই, বিকেলে অসীম সাহার প্রেস, সন্ধ্যায় রামপুরার সঙ্গীত পরিষদ- কোথাও রুদ্র নেই। আমি বিশ্বাস করি না রুদ্র আর মঞ্চে উঠবে না, কবিতা পড়বে না। কাঁধে কালো ব্যাগ নিয়ে রুদ্র আর হাঁটবে না, রুদ্র আর কথা বলবে না, হাসবে না, কবিতা পরিষদ- সাংস্কৃতিক জোট নিয়ে ভাববে না। এ আমার বিশ্বাস হয় না রুদ্র নেই।

রুদ্রকে আমি আমার সতেরো বছর বয়স থেকে চিনি। সেই সতেরো বছর বয়স থেকে রুদ্র আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল। আমাকে যে মানুষ অল্প অল্প করে জীবন চিনিয়েছে, জগৎ চিনিয়েছে- সে রুদ্র। আমাকে যে মানুষ একটি একটি অক্ষর জড়ো করে কবিতা শিখিয়েছে- সে রুদ্র। করতলে আঙুলের স্পর্শ রেখে রুদ্র আমাকে প্রথম বলেছে- ভালোবাসি। বলেছে- আমরা জ্বালাবো আলো কৃষ্ণপক্ষ পৃথিবীর তীরে, জীবনে জীবন ঘষে অপরূপ হৃদয়ের আলো। আমি এক অমল তরুণী, রুদ্রর উদোম উগ্র জীবনে এসে স্তম্ভিত দাঁড়িয়েছিলাম। যে কবিকে আমি নিখাদ ভালোবাসি, যে প্রাণবান যুবককে ভালোবেসে আমি সমাজ সংসার তুচ্ছ করেছি, হৃদয়ের দুকূল ছাওয়া স্বপ্ন নিয়ে যাকে প্রথম স্পর্শ করেছি, তাকে আমি অনিয়ন্ত্রিত জীবন থেকে শেষ অব্দি ফেরাতে পারিনি; নিরন্তর স্খলন থেকে, স্বেচ্ছাচার থেকে, অবাধ অসুখ থেকে আমি তাকে ফেরাতে পারিনি।

তার প্রতি ভালোবাসা যেমন ছিল আমার, প্রচণ্ড ক্ষোভও ছিল তাই। আর রুদ্র সেই মানুষ, সেই প্রখর প্রশস্ত মানুষ, যে একই সঙ্গে আমার আবেগ এবং উষ্মা, আমার ভালোবাসা এবং ঘৃণা ধারণ করবার ক্ষমতা রেখেছে। রুদ্রকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, দূর থেকেও। রুদ্র সেই মানুষ, রুদ্রই সেই মানুষ, যে কোনো দূরত্ব থেকে তাকে ভালোবাসা যায়। যৌথ জীবন আমরা যাপন করতে পারিনি, কিন্তু যত দূরেই থাকি, আমরা পরস্পরের কল্যাণকামী ছিলাম।’

Share