শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি। মোট মৃত্যুর এক–তৃতীয়াংশও ঢাকায়। তবে সংখ্যার দিক থেকে ঢাকায় মৃত্যু বেশি হলেও জেলাভিত্তিক নিশ্চিত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি চাঁদপুরে।
বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে দেশের ৬৪ জেলায় জেলাভিত্তিক নিশ্চিত আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাঁদপুরে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ২২৩ জন। আইইডিসিআর তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে মারা গেছেন ১০৬ জন। সে হিসাবে চাঁদপুরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। মৃত্যুর হারের দিক থেকে চাঁদপুরের পাশের জেলা কুমিল্লা আছে দ্বিতীয় স্থানে। এই জেলায় মৃত্যুর হার ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে আছে ঝিনাইদহ। এখানে মৃত্যুর হার ৩ দশমিক ১২ শতাংশ। এই তিন জেলায় মৃত্যুর হার ৩ শতাংশের ওপরে।
এর বাইরে ২৬টি জেলায় করোনায় মৃত্যুর হার ২ থেকে ৩ শতাংশের মধ্যে। আর ঢাকাসহ ৯টি জেলায় মৃত্যুর হার ১ শতাংশের কম। বাকি আট জেলা হচ্ছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাজবাড়ী, নরসিংদী, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও জয়পুরহাট। দেশে মৃত্যুর হার সবচেয়ে কম বান্দরবানে, শূন্য দশমিক ৫৪ শতাংশ। বাকি ২৬টি জেলায় মৃত্যুর হার ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে। আর সারা দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় নিলে মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪১ শতাংশ।
দেশে করোনায় মৃত্যু নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে বিস্তারিত কোনো গবেষণা হয়নি। চাঁদপুর, কুমিল্লায় মৃত্যুর হার কেন এত বেশি এবং অন্য জেলায় মৃত্যুর হার সে তুলনায় কম কেন, তার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো অজানা। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকার বাইরে পরীক্ষা কম হচ্ছে। যে কারণে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অনেকে পরীক্ষার বাইরে রয়ে যাচ্ছেন। এতে নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা কম হচ্ছে। মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার এটি একটি কারণ। আবার ঢাকার বাইরে চিকিৎসাসেবাও ততটা উন্নত নয়, মানুষের মধ্যে সচেতনতাও কম। এসব কারণে মৃত্যুর হার ঢাকার বাইরে বেশি।
চাঁদপুরে প্রথম করোনায় মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করা হয় গত ৪ এপ্রিল। এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই—এই চার মাসে সেখানে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটেছে। আবার এই জেলার মধ্যে চাঁদপুর সদর, হাজীগঞ্জ ও ফরিদগঞ্জে মৃত্যুর ঘটনা বেশি। তবে আগস্ট মাস থেকে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এসেছে। শুরুর দিকে চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে মৃত্যু বেশি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। জেলার কোনো সরকারি হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই।
চাঁদপুর জেলা সিভিল সার্জন মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এখানে আইসিইউ নেই, শুরুর দিকে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থাও ছিল না। এসব কারণে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটেছে। গত আগস্টে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা চালু হয়েছে। এটি হওয়ার পর আগস্ট থেকে মৃত্যু কমে এসেছে।
(আইইডিসিআর) তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে করা হয়েছে। সেখানে চাঁদপুরে ১০৬ জনের মৃত্যুর তথ্য আছে। তবে চাঁদপুরের সিভিল সার্জন দাবি করেছেন, জেলায় ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এক–তৃতীয়াংশ মৃত্যু ঢাকায়
৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্তের কথা জানানো হয়। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ১৮ মার্চ। শুরুতে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা ঢাকাতেই সীমিত ছিল। রোগীও বেশি ছিল ঢাকায়। পরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষাসুবিধা সম্প্রসারণ করা হয়। কিন্তু এখনো প্রতিদিন সারা দেশে যে পরীক্ষা হয়, তার অর্ধেকের বেশি হয় ঢাকায়। ঢাকায় রোগী শনাক্তও হচ্ছে বেশি। সংখ্যার দিক থেকে মৃত্যুও হচ্ছে বেশি। ঢাকা জেলায় নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় মোট শনাক্ত রোগী ছিলেন ১ লাখ ৭৭ হাজার ৯৯৩ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৫৪৭ জন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের এক–তৃতীয়াংশ ঢাকার বাসিন্দা। সংখ্যায় বেশি হলেও আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় ঢাকায় মৃত্যু হার কম। এখানে মৃত্যুর হার ১ শতাংশের নিচে, দশমিক ৮৬ শতাংশ।
মৃত্যুর হার বেশি ৩ বিভাগে
দেশের আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা, সিলেট, রংপুর, ময়মনসিংহ ও রাজশাহী বিভাগে মৃত্যুর হার ২ শতাংশের কম। আর চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনায় এটি ২ শতাংশের ওপরে। বিভাগভিত্তিক হিসাবে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে, ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এই বিভাগের ভোলা বাদে বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিতে মৃত্যুর হার ২ শতাংশের ওপরে। সবচেয়ে বেশি পটুয়াখালীতে ২ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
চট্টগ্রাম বিভাগে মৃত্যুর হার ২ দশমিক ২৮ শতাংশ। বিভাগের চাঁদপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনীতে মৃত্যুর হার ২ শতাংশের ওপরে। খুলনা বিভাগে মৃত্যুর হার ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এখানকার বাগেরহাট, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় মৃত্যুর হার ২ শতাংশের বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, জেলা শহরগুলোতে তুলনামূলক পরীক্ষা কম। শনাক্তের সংখ্যাও কম। এ কারণে মৃত্যুর হার বেশি হয়ে থাকতে পারে। কোন জেলায় কত মৃত্যু, হার কত, মৃত্যুর কারণ কী—এ বিষয়গুলো নিয়ে এখনো গবেষণা হয়নি। এটি করা খুব জরুরি। তিনি বলেন, এখন শনাক্তের হার কমে এসেছে। কিন্তু সারা দেশে এই হার একই রকম নয়। এদিকেও নজর দেওয়া দরকার।(প্রথম আলো)
বার্তা কক্ষ,১৭ সেপেটম্বর ২০২০