ইসরায়েলি ভয়াবহ তাণ্ডবে গাজা এখন মৃত্যুপুরী। হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এই নগরীতে আজ ঈদ। পুরো রমজান মাস ফিলিস্তিনিদের কেটেছে দুঃসহ কষ্টে। এ সময়ে তাদের সঙ্গী ছিল ইসরায়েলি বোমা, রক্ত আর মৃত্যুর ভয়।
শত শত ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি গোলায় নিহত হয়েছেন। রোজার মধ্যেও ছিল না খাবার, ছিল না মাথা গোঁজায় ঠাঁই, সারা দিন রোজা রেখে এক গ্লাস পানি পাওয়াও যেখানে কষ্ট সেখানে ঈদ এসেছে।
টানা দ্বিতীয় বছরের মতো গাজায় ঈদুল ফিতরের উৎসবমুখর পরিবেশ নেই। হাজার হাজার পরিবার তাদের ঘরবাড়ি এবং প্রিয়জনদের হারানোর শোকে অস্থায়ী তাঁবুতে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে আছে।
একসময়ের প্রাণবন্ত রাস্তাগুলো, যা সাধারণত সাজসজ্জায় সজ্জিত, শিশুদের হাসিতে ভরা ছিল, এখন তা ধ্বংসস্তূপ। ইসরায়েলি বোমাবর্ষের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের নীরব স্মারক এগুলো।
ইসলামিক ক্যালেন্ডার অনুসারে, বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা রবিবার বা সোমবার ঈদুল ফিতরের প্রথম দিন উদযাপন করবে, যা চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু গাজায় ঈদ এলেও উদযাপন করার মতো আনন্দ নেই।
ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ‘তাদের উদযাপনের কিছুই নেই’। ২০২৫ সালের ২ মার্চ থেকে ইসরায়েল সকল ক্রসিং বন্ধ করে দেয়। সকল মানবিক, চিকিৎসা এবং ত্রাণ সহায়তা প্রবেশে বাধা দিয়ে গাজা উপত্যকায় পূর্ণ অবরোধ আরোপ করেছে ইসরায়েল। বাজার প্রায় খালি এবং অবশিষ্ট যা পণ্য রয়েছে তার দাম চড়া, যার ফলে যুদ্ধের কারণে দরিদ্র ফিলিস্তিনিদের জন্য মৌলিক চাহিদা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
গত সপ্তাহে গাজা সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, হামলা এবং জীবন রক্ষাকারী সাহায্যের বাধার কারণে এই অঞ্চলটি দুর্ভিক্ষের প্রথম পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
গাজা শহরের পশ্চিমে অবস্থিত আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে, ২৯ বছর বয়সী সুয়াদ আবু শাহলা একটি ছেঁড়া কাপড়ের তাঁবুর বাইরে বসে তার কান্নারত সন্তানকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
চার সন্তানের মা সুয়াদ ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলি বাহিনী বোমাবর্ষণ করলে বেইত লাহিয়ায় তার বাড়ি হারিয়ে ছিলেন। তারপর থেকে, তিনি এবং তার পরিবার একটি ভঙ্গুর আশ্রয়স্থলে নির্মম পরিস্থিতি সহ্য করেছেন।
তিনি বলেন, ‘গাজায় ঈদের অর্থ এখন আর নেই। যুদ্ধের আগে, আমরা শিশুদের জন্য পোশাক এবং মিষ্টি কিনতাম। এখন আমরা রুটিও কিনতে পারি না। আমার বাচ্চারা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা কি নতুন পোশাক পাব? আমরা কি কখনও বাড়ি ফিরব?’ কিন্তু আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।’
গাজা শহরজুড়ে যুদ্ধের ক্ষত সর্বত্র। ধসে পড়া ভবন, ধ্বংসস্তূপে ভরা রাস্তা এবং ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো সংঘাতের ভয়াবহতা প্রতিফলিত হচ্ছে। আল-রিমাল পাড়ায়, যা একসময় গাজা শহরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকাগুলোর মধ্যে একটি ছিল, তার বেশিরভাগ ভবন সমতল হয়ে গেছে অথবা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুড়ে যাওয়া গাড়ি এবং পতিত বিদ্যুৎ লাইন নির্জন রাস্তায় পড়ে আছে।
মারওয়ান আল-হাদ্দাদ নামে একজন বলেন, ‘গত বছর যুদ্ধ সত্ত্বেও আমরা আনন্দের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছি। এখন আমি আমার বাচ্চাদের জন্য মিষ্টিও কিনতে পারছি না। তিনি গত সপ্তাহে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি উত্তেজনার পর বেইত হানুন থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি কীভাবে আমার বাচ্চাদের বলতে পারি যুদ্ধ কবে শেষ হবে?’ তিনি আরো বলেন, ‘যখনই আমরা বোমা হামলার শব্দে ঘুম থেকে উঠি, তখনই আমরা বুঝতে পারি যে শান্তি এখনও অনেক দূরে।’
ব্যবসায়িক মালিকদের জন্য পরিস্থিতি ঠিক ততটাই ভয়াবহ। যুদ্ধের আগে গাজা শহরের কেন্দ্রস্থল ওয়েহদা স্ট্রিটে বেশিরভাগ দোকান এখন বন্ধ অথবা ধ্বংস হয়ে যায়। মিষ্টির দোকানের মালিক ইব্রাহিম সিয়াম তার ব্যবসার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, ‘ঈদের সময় আমি কেজি কেজি মিষ্টি বিক্রি করতাম। এখন, মানুষ রুটি খুঁজে পায় না।’ গাজা উপত্যকার উত্তরে জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে বাজারের কার্যক্রম স্থবির রয়ে গেছে। পোশাকের দোকানের মালিক আব্দুল রহমান আল-জেইন বলেন, ‘ঈদের পোশাক কেনার সামর্থ্য খুব কম লোকেরই আছে। মানুষ বেঁচে থাকার দিকে মনোনিবেশ করছে।’
দক্ষিণ গাজা উপত্যকার খান ইউনিসে ৩২ বছর বয়সী ফাতিমা কুদেইহ বলেন, ‘আমার সন্তানরা জিজ্ঞাসা করে কেন আমরা আগের মতো নতুন পোশাক কিনি না, বাজারে যাই না। আমি তাদের বলি, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে আমরা পোশাক কিনব, কিন্তু তারা আমার কথায় বিশ্বাস হারাতে শুরু করেছে।’
বেঁচে থাকার সংকল্প
দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। ফিলিস্তিনি নারীরা কাক নামে ঐতিহ্যবাহী ঈদের বিস্কুট তৈরি করছেন। ১৮ মার্চ ২০২৫ তারিখে পুনরায় শুরু হওয়া ইসরায়েলি সামরিক আক্রমণ সত্ত্বেও এই নারীরা চাচ্ছেন সন্তানদের মনোবল কিছুটা চাঙ্গা করতে। এক সমুদ্র শোক, যুদ্ধ, ঘরবাড়ি ও প্রিয়জনদের হারানো এই মানুষগুলো আপ্রাণ চেষ্টা করছে তাদের সন্তানদের মন ভালো করতে।
কাওসার হুসেন আশ্রয়কেন্দ্রের কোণে একটি মাটির চুলার পাশে বসে ঈদের বিস্কুট বেক করার জন্য আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছেন, তখন ইসরায়েলি আর্টিলারি গাজা উপত্যকার কাছাকাছি এলাকায় গোলাবর্ষণ করছে। যুদ্ধের কারণে রান্নার গ্যাস নেই, তাই নারীরা রান্নার জন্য পিচবোর্ড এবং কাঠ ব্যবহার করছেন, যা সময়সাপেক্ষ এবং ক্লান্তিকর। ধোঁয়া উপেক্ষা করে হুসেন সাবধানে ট্রেতে বিস্কুট রেখে বেক করা শুরু করেন।
তিনি বলেন, ‘এখানকার পরিবেশ খুবই দুঃখজনক। আমরা অনেক আত্মীয়স্বজন এবং প্রিয়জনকে হারিয়েছি। আমরা একটি বড় মানবিক সংকটে ভুগছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এমন এক জাতি যারা জীবনকে ভালোবাসি। আমরা চাই না আমাদের সন্তানরা বঞ্চনার মধ্যে থাকুক। আমরা তাদের যা কিছু সম্ভব তাই দেওয়ার চেষ্টা করি, এমনকি যদি তা সামান্যও হয়।’
যুদ্ধের আগে তিনি ঈদের সময় প্রায় ৯ কিলোগ্রাম (১৯.৮ পাউন্ড) বিস্কুট বানাতেন। এই বছর, তিনি মাত্র এক কিলোগ্রাম (২.২ পাউন্ড) কুকিজ তৈরি করছেন শুধুমাত্র যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের জন্য কিছুটা সান্ত্বনা বয়ে আনার আশায়। যদিও তাদের চারপাশে শোক বিরাজ করছে। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, ঈদ উদযাপন করা উচিত।
যুদ্ধের মধ্যে আনন্দ
আরেকজন ফিলিস্তিনি নারী উম্মে মোহাম্মদও তার সন্তানদের এবং নাতি-নাতনিদের জন্য বিস্কুট তৈরি করে তাদের ঈদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি আনাদোলুকে বলেন, ‘গণহত্যার সময় ঈদের আচার-অনুষ্ঠান থেকে শিশুদের যা হারিয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য আমরা সামান্য কিছু বিস্কুট তৈরি করতে পেরেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘শিশুরা কষ্টে আছে আমরা খুশি করার চেষ্টা করছি এবং আমরা কেবল এটাই দিতে পারি।’
২০২৫ সালের ১৮ মার্চ ইসরায়েল গাজায় নতুন করে হামলা শুরু করেছে। এতে গত ১১ দিনে ৮৯০ জন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর পর থেকে ইতিমধ্যে ইসরায়েলি হামলায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। অন্যদিকে এ মাসের শুরু থেকে গাজায় ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে দেয়নি ইসরায়েল। হামাসের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য ইসরায়েল এই কৌশল নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নভেম্বরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ছিটমহলে যুদ্ধের জন্য ইসরায়েল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখিও হচ্ছে।
সূত্র : আলজাজিরা, আনাদোলু, সিনহুয়া