জাতীয়

মুসলিম রেনেসাঁ’র কবি নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক

চাঁদপুর টাইমস:

‘আমি ইন্দ্রানী-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য/ মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণ তূর্য…’ একদিকে প্রেম, একদিকে বিদ্রোহ- দুয়ে মিলেই নজরুলের জাগানিয়া সত্তা।

‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/এক সে আকাশ মায়ের কোলে/যেন রবি শশী দোলে/এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’

প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি,সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, মানবতার কবি নজরুলকে বোঝার জন্য কিংবা বোঝানোর জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ তার সৃষ্টি অসংখ্য এমন চরণ।

বিদ্রোহী হয়ে ওঠা বা বিদ্রোহ প্রকাশের ধরন যে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে উৎক্ষিপ্ত। মানবসত্তা বিকাশের জয়গান মূলত যে কোনো বিদ্রোহী সুরের সঙ্গেই একাট্টা হয়ে অনুরণিত হয় ব্যক্তিমানসে।

যা থেকে প্রথমে দ্রোহ এবং পরবর্তীতে বিদ্রোহী চেতনার জন্ম নেয়। নজরুলের এমনই প্রকাশ।

সাম্য-মানবতা আর প্রেমের কবি, বিদ্রোহের তূর্যবাদক বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট)।

শিল্পী জীবনের সীমিত পরিসরে নজরুলের বহুমুখী প্রতিভার মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ, তা সন্দেহাতীত। তবে এ কথা বলা যায় প্রেম-দ্রোহ যার মনে-মননে এবং কবিতায় ফুটে উঠতে পারে একই হাতে সে কবি মহাকবি না হয়ে কী পারেন!

কাজী নজরুল ইসলাম তার সময়কে ভেদ করে এগিয়েছেন। যেটুকু কাব্য ও সাহিত্য চর্চার সময় তিনি পেয়েছেন ব্যক্তি জীবনে; কাজ করে গেছেন সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই।

গাহি সাম্যের গান-, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান। এটি নজরুলে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিচ্ছবি।

নজরুলের মানবসত্ত‍া এবং তার বিদ্রোহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ নজরুলকে বহুবিধ বিশ্লেষণে ভূষিত করেছেন। যার মধ্যে বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, মানবতার মুক্তিদূত এবং সর্বতোভাবে প্রেমের কবি অন্যতম।

শুধু তাই নয় প্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে নজরুলের আরেক ধরনের বিদ্রোহ সামনে ভেসে আসে। যেখানে কখনও প্রেমিকসত্তা নিরঙ্কুশভাবে বিলীন প্রেমাস্পদের কাছে অথবা কখনও বা প্রেমবিদ্রোহ জাগরুক থাকে বিরহের যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দিয়ে।

প্রেমের ক্ষেত্রে নজরুলের এই যে দ্বিমুখী বিদ্রোহ এটা তার বিদ্রোহী চেতনাকে প্রাণবন্ত করার আরেকটি দিক। মূলত নজরুল বিদ্রোহ করেছেন অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে।

শোষিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, অবহেলিত সর্বোপরি দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের জয়গান তিনি করেছেন সোচ্চারকণ্ঠে। যার কারণে তাকে সাম্যের কবি, মানবতার কবি বলা হয়।

নজরুলের সাহিত্য রচনার কাল ১৯১৯ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত (বাংলা ১৩২৬ থেকে ১৩৪৯)। কাজী নজরুল ইসলাম ওরফে দুখু মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ সালে। বেড়ে ওঠা চমর দরিদ্রতার মধ্যে।

বিশ শতকের প্রথম চার দশকের মধ্যেই নজরুলের মানস গঠন ও বিকাশ। তার সাহিত্যে তাই প্রতিফলিত হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধের নানা দিক। যুদ্ধের উত্তেজনাকে তিনি অনুভব করেছিলেন ভীষণভাবে।

স্বপ্ন দেখেছিলেন নবজাগরণের। নজরুল নিয়ে গবেষণার কাজ করা ড. রিটা আশরাফ তার বইয়ে লিখেছেন, এ সময়ে নজরুলের দৃষ্টিপথে ঊদিত হয়েছে ১৯০৫ সালে আয়ারল্যান্ডের ‘সিনফিন’ আন্দোলন উদ্ভূত প্রবল গণ-উত্থান।

নজরুল ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে সংঘটিত বর্বর হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করে লিখেছেন ‘ভায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ’ প্রবন্ধ।

১৯২০ সালের খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন ও রুশ বলশেভিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পটভূমিতে রচিত হয়েছে নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস।

কিন্তু তা তার কাছে কোনো বিষয় ছিল না। জানাজানি হয়ে গেলো, এ বালকটি কোনো সাধারণ ছেলে নয়। একদিন চোখে পড়ে গেলেন দারোগা কাজী রফিজউল্লাহ। তিনি তাকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুরে (১৯১৪)।

সেখানে আবার স্কুলে দিলেন নজরুলকে। নিজের মেধা দিয়ে শিক্ষকদের চমৎকৃত করেন তিনি। চুরুলিয়া ও দরিরামপুরের প্রকৃতি-পরিবেশ পৃথক। নিজ এলাকা বর্ধমানের লাল মাটির রুক্ষ পরিবেশ ও গাছপালার ফিকে সবুজের বদলে দরিরামপুর তথা ময়মনসিংহের নরম-সরস মাটি এবং গাঢ় সবুজ-শ্যামলিমা নজরুলের চোখে মায়ার অঞ্জন বুলিয়ে দিয়েছিল।

বছরখানেকের কিছু বেশি সময় ছিলেন সেখানে। তারপর উড়াল দিলেন। তিনি আর কখনো দরিরামপুরে পা রাখেননি, কিন্তু মধুর স্মৃতি বোধহয় সারা জীবনই তাকে ঘিরে ছিল।

এরপর নিজ গ্রামে ফিরে গেলেন নজরুল। সেখোনে এক পরিচিত লোকের সহায়তায় ভর্তি হলেন রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে। সেখানে ভালো ছাত্র হিসেবে আবার তার কদর জুটলো। রানীগঞ্জে এসে তিনি বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে (পরবর্তীকালে প্রখ্যাত লেখক ও চলচ্চিত্রকার)।

প্রবেশিকা পরীক্ষার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে নিয়তির সচল চাকা এবার তাকে ঠেলে নিয়ে গেল আরেক জগতে। সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন নজরুল (১৯১৭)। কেন, তার সঠিক ব্যাখ্যা নেই।

হতে পারে দারিদ্র্য আর ভ্রাম্যমাণ জীবনের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন তিনি। পড়াশোনা তাকে আর ধরে রাখতে পারছিল না। হতে পারে অজানা জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল।

এও হতে পারে যে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বাঙালি তরুণ-যুবকদের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য সরকারি উদ্যোগে যে ব্যাপক প্রচারণা চলছিল তাতে আকৃষ্ট হয়েই তিনি সেনা দলে নাম লেখান।

সৈনিক জীবন তাকে আমূল বদলে দিয়েছিল। এটি ছিল তার জীবনের অন্যতম একটি দিক। তবে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর নজরুল সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

এরপর নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি বেতারে কাজ করেছেন নজরুল। এ সময় তার সৃষ্টিকর্ম আরও বেশি বিস্তৃত হয়। এমতাবস্থায় ১৯৪২ সালে কবি নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন।

হারিয়ে ফেলেন বাকশক্তি। তবে তার অসুস্থতার বিষয় সুস্পষ্টরূপে জানা যায় ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়।

কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত কবি নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ সালে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল চিকিৎসা কমিটি। এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সহযোগিতা করেছিলেন। চার মাস রাঁচিতে ছিলেন কবি।

নজরুল নিভৃতে থাকলেও তার কবিতা ও গান আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে তথা মুক্তি সংগ্রামে ছিল অত্যন্ত অনুপ্রেরণার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়।

একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ওই বছরই ২৯ আগস্ট নজরুল মৃত্যুবরণ করেন। চলে যান পৃথিবী ছেড়ে।

নজরুল লিখেছিলেন ‘মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই/ যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই…’ সেই ইচ্ছে পূরণে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে অন্তিমশয়নে সমাহিত করা হয়।

চাঁদপুর টাইমস- ডিএইচ/2015।

Share