Home / বিশেষ সংবাদ / মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন পবিত্র আল আকসা
Al-ASKA-...
ফাইল ছবি

মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন পবিত্র আল আকসা

ইসলামে আল আকসার গুরুত্বের কথা সবারই জানা থাকার কথা। পৃথিবীর ১৮০ কোটি মুসলমানের হূদয়ের স্পন্দন পবিত্র আল আকসা। পবিত্র কোরআনুল কারিমে আল আকসার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকায় এর গুরুত্ব আরো মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন,‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি,যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রিবেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিককে আমি বরকতময় করেছি,যেন তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই।’(সুরা বনি ইসরাইল : ১) এ আয়াতে ‘যার চারদিককে আমি বরকতময় করেছি’ বলে আল্লাহ তাআলা আল আকসার পাশাপাশি জেরুজালেমের গুরুত্বের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

পবিত্র কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর নির্মিত হয় আল আকসা। তাই এটিই পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম নগরী। ১৯৮১ সালে একে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষকের মতে,এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর।

তবে তা মক্কার পর দ্বিতীয় প্রাচীনতম শহর। একে পৃথিবীর কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওল্ড সিটি ঘোষণার অনেক আগেই নবীজি (সা.) একে ওল্ড সিটি বা প্রাচীনতম শহরের মর্যাদা দিয়ে গেছেন।

হজরত আবুজর গিফারি (রা.) বলেন, “আমি নবীজি (সা.)-কে প্রশ্ন করলাম—জমিনে কোন মসজিদ প্রথম তৈরি হয়েছিল? তিনি বললেন, ‘মসজিদে হারাম’। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘মসজিদে আকসা’। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, এ দুটির মধ্যে ব্যবধান কত? তিনি বললেন, ৪০ বছর।” (বুখারি ও মুসলিম) পৃথিবীর ইতিহাসে আল আকসা প্রশ্ন হলো, আল আকসার অধিকার কাদের? ফিলিস্তিন, জেরুজালেম ও আল আকসা একচ্ছত্রভাবেই ছিল মুসলমানদের দখলে।

নবীজি (সা.)-এর প্রিয়তম সাহাবি হজরত ওমর (রা.)-এর সময় ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে তা নিয়মতান্ত্রিক দাওয়াতের মাধ্যমেই মুসলমানদের অধিকারে আসে। ৪৬১ বছর পর ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা মসজিদটি দখল করে তার ভেতরে পরিবর্তন করে। গির্জায় পরিণত করে এর একটি অংশকে।

খ্রিস্টানদের দখলে ৮৮ বছর থাকার পর ১১৮৭ সালে গাজি সালাহউদ্দিন আইয়ুবি খ্রিস্টানদের হাত থেকে আল আকসা উদ্ধার করে তাতে মুসলমানদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বিভিন্ন কৌশলে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী ভৌগোলিক দিক থেকে অত্যন্ত কৌশলগত এ পবিত্র স্থান দখলের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে ইহুদি-খ্রিস্টানরা।

পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ এ স্থানের সঙ্গে তাদের ধর্মের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এটি আয়ত্তের জন্য প্রয়োজনে ধর্মগ্রন্থ বিকৃত করে হলেও তা অধিকারের ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

মানবতার শত্রু ইহুদি জাতি আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশপ্ত। হজরত মুসা (আ.)-এর সময় তাদের জন্য প্রদত্ত কুদরতি খাবারে অকৃতজ্ঞ হওয়ায় অভিশপ্ত হয়। প্রতি শনিবারে হজরত দাউদ (আ.)-এর জাবুর পাঠের সময় সমুদ্রের কিনারে মাছেরা যখন তিলাওয়াত শুনত, তখন ইহুদিরা ওই মাছগুলো ধরে নিত।

আল্লাহ তাদের এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তারা অপকৌশলে মাছ আটকেই রাখত। তাদের ওপর আল্লাহ তাআলার অভিশাপ নেমে আসে। তারা প্রথমে বানরে পরিণত হয়ে তারপর সব মারা যায়। যুগে যুগে তারা মানবতার শান্তির জন্য ছিল হুমকিস্বরূপ। তাই আল্লাহ কর্তৃক এরা অভিশপ্ত হয়।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের ওপর আরোপ করা হলো লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা।’ (সুরা বাকারা : ৬১) কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী এরা আসলেই পরমুখাপেক্ষী ছিল। এদের কোনো নিজস্ব ভিটা ছিল না। অভিশপ্ত এ জাতিকে কেউ মেনে নিতে পারেনি। কোনো ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে যেমন কেউ নিজের গ্রামে রাখা নিরাপদ মনে করে না, অন্য জায়গায় সরিয়ে দিতে চায়, তেমনি ব্রিটিশরাও বিশ্বসন্ত্রাসী ইহুদিদের নিজেদের দেশে রাখা নিরাপদ মনে করেনি।

মানবতার বিষফোড়া ইহুদিদের মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে তারা। ব্রিটিশরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদিদের এনে মুসলমানদের সম্মানিত নগরী জেরুজালেমে পুনর্বাসিত করে তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করে। ১৯১৭ সালে জেরুজালেম ব্রিটেনের দখলে চলে গেলে শুরু হয় এক কালো অধ্যায়ের।

ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেলফোর তাদের পরিকল্পনার কথা জানান ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে। এ এলাকায় আগে থেকেই বসবাস করে আসা ইহুদিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। শুরু হয় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদিদের এনে ফিলিস্তিনে অভিবাসনের প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বাহিনী লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করলে সেখান থেকেও হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনমুখী হয়।

ইউরোপ থেকে হাজার হাজার ইহুদিকে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ইহুদিরা ফিলিস্তিনে দখলদার ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদে জায়গা কিনে কিনে বসতি স্থাপন করতে থাকে। মুসলমানরা বুঝতে পারে যে তারা ক্রমেই তাদের মাতৃভূমির জমি হারাচ্ছে। এত দিনে ইহুদিরা ব্রিটেনের মদদে জায়গা দখল করে স্বাধীন ফিলিস্তিনের মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হয়ে যায়।

অন্যায়ভাবে বসবাসকারী ইহুদির সংখ্যা হয়ে যায় গোটা ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। আর ব্রিটেন ব্যাপারটি কৌশলে জাতিসংঘে নিয়ে যায়। জাতিসংঘ সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ১০ শতাংশ জমির মালিকদের জন্য গোটা ফিলিস্তিনের অর্ধেকেরও বেশি ভূমি বরাদ্দ করে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।

জাতিসংঘ ইহুদিদের শুধু ফিলিস্তিনিদের জায়গা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। ভয়ংকর এক কৌশল অবলম্বন করে পবিত্র ও প্রাচীন নগরী জেরুজালেম নিয়ে। মুসলমানদের নিরঙ্কুশ মালিকানায় থাকা আল আকসাসহ জেরুজালেমের অধিকার ফিলিস্তিন-ইসরায়েল কাউকেই না দিয়ে এর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা করে জাতিসংঘ। এতে ইসরায়েল খুবই খুশি হয়।

কারণ, তা তো মূলত মুসলমানদের জায়গা। আপাতত আল আকসা ও জেরুজালেমের প্রকৃত মালিকদের নিরঙ্কুশ মালিকানার বিষয়টি প্রতিহত করা গেল। তবে এ ঘোষণার সময় জাতিসংঘের আইনে আল আকসা ও জেরুজালেমের মালিকানা এককভাবে ফিলিস্তিনিদের হাতে না থাকলেও তার বাস্তব নিয়ন্ত্রণ এককভাবে মুসলমানদের হাতেই ছিল। আল আকসায় কোনো ইহুদি প্রবেশ করতে পারত না। তা ছিল শুধুই মুসলমানদের।

ইতিহাসে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত ১৯৬৭ সালের ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ইসরায়েল, মিসর, জর্দান ও সিরিয়ার মধ্যকার যুদ্ধে ইসরায়েল বিজয়ী হয়। এর মধ্য দিয়ে পুরো জেরুজালেমে বাস্তব নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠা করে ইসরায়েল। পুরো আল আকসার একাংশকে তাদের ধর্মের পবিত্র স্থান ঘোষণা করে।

জেরুজালেমে ইহুদি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও আইন লঙ্ঘন করেই জেরুজালেমে ইহুদি বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখে। তবে আজ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রই জেরুজালেমে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণকে বৈধতা দেয়নি। সব রাষ্ট্রই এর বিরোধিতা করে আসছে। এমনকি জেরুজালেমের বাস্তব নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে চলে গেলেও এখনো মসজিদে আকসার সার্বিক পরিচালনা ফিলিস্তিনের নেতৃত্বাধীন ‘ইসলামী ওয়াকফের’ তত্ত্বাবধানেই রয়েছে।

জাতিসংঘ যখন দেখল যে জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ক্রমেই আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভ করছে, তখন তারাও তাদের কৌশল পাল্টে ফেলে। জেরুজালেমে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে জাতিসংঘ। জেরুজালেম ইসরায়েলের অংশ হিসেবে ঘোষণার ব্যাপারটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ৪৭৮ নম্বর প্রস্তাব দ্বারা বাতিল করা হয়।

অন্যদিকে আল আকসায় ইহুদিদের ‘পবিত্র স্থান’ ঘোষণাকে নাকচ করে মুসলমানদের নিরঙ্কুশ মালিকানার কথা ঘোষণা করে। ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবর জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো তাদের ভোটাভুটির মাধ্যমে ঘোষণা করে যে মসজিদে আকসা কেবলই মুসলমানদের। এতে ইসরায়েলের কোনো অধিকার নেই। তাদের অধিকার না থাকায়ও তারা যে আগ্রাসন চালাচ্ছে,ইউনেসকো তারও প্রতিবাদ জানায়।

সুতরাং আল আকসা ও জেরুজালেম সব আইনের ভিত্তিতেই শুধু মুসলমানদের। এতে ইহুদিদের কোনো অধিকার নেই। ১৮০ কোটি মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে পদক্ষেপ নিলে ইহুদিরা এর নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য হবে। যেহেতু এখানে মানবতা ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। তাই মানবতাবোধের জায়গা থেকে অমুসলিমদেরও উচিত ইসরায়েলি দখলদারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া।

লেখক : যুবায়ের আহমাদ , জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কারি ও খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ, গাজীপুর ।

মন্তব্য