মুল্লুকে চলো’র ১০১ বছর : বঞ্চনা ফুরায়নি চা শ্রমিকদের

চা শ্রমিকদের বঞ্চনার ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় ‘মুল্লুকে চলো’। ১৯২১ সালের ২০ মে গভীর রাতে শ্রমিকের রক্তঝরা এ দিবসের ১০১ বছর পূর্ণ হয়েছে শুক্রবার। এ দীর্ঘ সময় ধরে চা শ্রমিকেরা অধিকার আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে গেলেও তাদের বঞ্চনার অবসান হয়নি। ফুরায়নি মানবেতর জীবনের দিনযাপন।

এ আন্দোলনের ১০১ বছর উপলক্ষে সমগীত আয়োজন করে ‘মুল্লুকে চলো আন্দোলনের ১০১ বছর-চা শ্রমিকদের বঞ্চনা ও সংগ্রামের ইতিহাস’ শীর্ষক আলোচনার। ঢাকার পরীবারের সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে শুক্রবার সন্ধ্যায় আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড.আনু মুহাম্মদ,শিল্পী কফিল আহমেদ,শিল্পী-সংগঠক অমল আকাশ প্রমুখ।

আনু মুহাম্মদ এ ঐতিহাসিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনার আয়োজন করায় এবং তরুণদের যুক্ত করায় সমগীতকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন,‘পুঁজির বিকাশের পেছনে নিপীড়নের ভয়ঙ্কর ইতিহাস থাকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিদ্যায়তনেও এগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকে।

দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কেমন করে অর্থনৈতিক মানোন্নয়ন সম্ভব বা প্রযুক্তিকে সেই কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেই দিকে নীতিনির্ধারকদের কোনো আগ্রহ নেই। ’

তিনি সারা পৃথিবীর মাইগ্রেটেড শ্রমিকদের নিপীড়নের চিত্র ও সর্বপ্রাণের অধিকার আদায়ের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন,‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে। জনজীবন উন্নয়নের সাথে জড়িত কোনো গবেষণা বা প্রকল্প তারা জনসম্মুখে আনে না। তিনি চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে অধিকার আদায়ের চলমান লড়াইয়ের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন।

কবি ও শিল্পী কফিল আহমেদ বলেন,‘চা চাষের ভূমিতে যেসব লতাগুল্ম ছিল, চা চাষের ফলে সেগুলোকে অবাঞ্ছিত করেছে চা মালিকেরা। ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিকতা হারিয়ে গেছে। বাণিজ্য কখনো সর্বপ্রাণের কল্যাণ নিয়ে ভাবে না। মানুষ শ্রম দিচ্ছে তার মঙ্গলের বিপরীতে।

চা শ্রমিকদের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া জরুরি বিষয়। তবে কেবল এ সব দাবি মিটিয়ে কখনোই চা শ্রমিকদের জীবনের মানের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে না। তাদের বেঁচে থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এ ভূমিকেও তার নিজস্ব রূপ ফিরিয়ে দেয়ার লড়াই জারি রাখতে হবে। ’

শিল্পী অমল আকাশ বলেন,‘এতোগুলো বছর এদেশে কাটিয়েও চা শ্রমিকেরা এদেশের ভূমিকে নিজের ভূমি বলে ভাবতে পারছে না। কারণ তারা জানে,আজকে কাজ চলে গেলে কাল সে ভূমি থেকে বিতাড়িত হবে।

এদের ট্রেড ইউনিয়ন নেই,মজুরি এখনো যে কোনো শ্রমখাতের চেয়ে সর্বনিম্ন। এটাই এখন তার ‘মুল্লুক’। আমাদের সবাইকে এ বঞ্চিত জীবনের দায় নিতে হবে এবং তার ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। ’

আলোচনা পর্বের শেষে গান পরিবেশন করেন গানের দল সমগীত,লীলা ব্যান্ড এবং শিল্পী কফিল আহমেদ।

বঞ্চনার ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ব্রিটিশ চা মালিকেরা ভারতবর্ষের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে নিজেদের ভূমি ছাড়িয়ে আসাম-বাংলা অঞ্চলের চা বাগানগুলোতে নিয়ে এসেছিল। বিনিময়ে তারা পেয়েছেন সীমাহীন নির্যাতন,নিপীড়ন।

এ দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তির আশায় ১০১ বছর আগে অবিভক্ত আসাম-বাংলা অঞ্চলের চা শ্রমিকেরা যখন নিজের ভূমিতে ফিরে যেতে চেয়েছিল,মালিকেরা ফেরার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের কাছে রেলের টিকেট বিক্রি করা হয়নি। এমনকি রেলে উঠতেও দেয়া হয়নি।

এরপর তারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য রেলপথ ধরে প্রায় ১৭ দিন পায়ে হেঁটে চাঁদপুর জাহাজঘাটায় পৌঁছালে ১৯২১ সালের ২০ মে গভীর রাতে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী শত শত ঘুমন্ত চা শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল।

ওই ঘটনার পর নিজের ভূমিতে অনেকেই ফিরে যেতে পেরেছিলেন। আটকে যাওয়া শ্রমিকেরা নানা বৈষম্যের বেড়াজালে পড়ে আছেন এবং এখনো ‘মানুষ’ হিসাবে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু ফিরে পায়নি।

২১ মে ২০২২
এজি

Share