ফিচার

প্রতিবন্ধী বলে আমাকে দূরে রেখো না

আমি মানুষ হয়ে জন্মেছি, আমি দেখতেও ঠিক মানুষের মতো। আমি আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছি মানুষের কথা, আমি হঠাৎ বুঝতে শিখেছি আমি অন্যের থেকে কিছুটা আলাদা। আমি নরমাল মানুষ নই।

আমার জন্মের শুরুতে আমি ভিন্ন। আমার ভিতর ভালোবাসা রয়েছে, আমার চিন্তায় আমিও স্বপ্ন দেখি যে আমি ডাক্তার হবো, ইঞ্জিনিয়ার হবো, আদর্শ শিক্ষক বা শিল্পী হবো।

কিন্তু আমাকে সবাই দেখামাত্রই কেন যেন একটু অন্যভাবে তাকায়! কিন্তু কেন? মাকে প্রশ্ন করি, মা কেন যেন মন খারাপ করে হঠাৎ অন্য কথা বলেন! কী অপরাধ করেছি আমি?

আমার মধ্যেও তো ভালোবাসা রয়েছে? আমি এখন বুঝতে শিখেছি, আমার যারা সমবয়সী তারাও কিছুটা হাসি তামাশা করে আমাকে নিয়ে, কারণ আমার একটি পা যা দেখতে অন্যদের মতো নয়।

আমার কোনো বন্ধু নেই, কেউ আমার সঙ্গে খেলতে বা কথা বলতেও চায় না। যতোটুকু বুঝেছি আমি সমাজের আর দশজনের মতো নই। তাই আজ আমি প্রতিবন্ধী।

জন্ম আমার ধন্য হবে মাগো, আপন করে আমায় যদি তোমার বুকে রাখো। এই হলো একজন প্রতিবন্ধীর মনের কথা।

সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী আর দশজন যে কাজগুলো করতে পারে ইমপেয়ারমেন্টের কারণে এই প্রতিবন্ধীরা সেই কাজগুলো করতে পারে না।

দেহের কোনো অংশ বা তন্ত্র যদি আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে, ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায় সে অবস্থাটিকেই ইমপেয়ারমেন্ট বলা হয়।

প্রতিবন্ধিকতা অনেক প্রকার হতে পারে। যেমন: শারীরিক প্রতিবন্ধী, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, শ্রবণ প্রতিবন্ধী, বাক প্রতিবন্ধী, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও বহুবিধ প্রতিবন্ধী।

প্রতিবন্ধিকতার নানাবিধ জানা অজানা কারণ রয়েছে, যেমন: বংশানুক্রমিক, দুর্ঘটনা, বিষক্রিয়া, পুষ্টির অভাব, ভিটামিনের অভাব, আয়োডিনের অভাব বা কোনো কারণ ছাড়াও এটা হতে পারে।

শিশুর জন্মের পূর্বে মায়ের বয়স ১৫ বছরের কম বা ৫০ বছরের বেশি হলে, গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টির অভাব হলে, মা যদি মদপান, ধূমপান করে এবং তামাক ব্যবহার করে তাহলেও শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এসব কারণ ছাড়াও দুর্ঘটনাজনিত কারণেও হতে পারে। উল্লিখিত ঘটনার কোনো একটা কারণে যদি একজন মানুষ প্রতিবন্ধিকতার শিকার হয়, তাহলে সে কি অভিশপ্ত জীবন যাপন করবে নাকি স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় জীবনযাপন করবে?

এ বিষয়ে আমরা কতটাই বা সচেতন তা জাগ্রত বিবেকের কাছে প্রশ্ন করা যেতে পারে। রাষ্ট্র সুবিধাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও কত সংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষ সে সুবিধা প্রাপ্ত হচ্ছে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।

প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে মূলধারায় নিয়ে আসতে হলে সর্বপ্রথম যে জিনিসটির প্রয়োজন তা হলো প্রত্যেক উপজেলায় সংখ্যানুপাতে একাধিক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।

তাদের জীবন মানের উন্নয়ন এবং ভিক্ষাবৃত্তির বিপরীতে বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শতভাগ ভাতার ব্যবস্থা করা।

সর্বোপরী তারাও যে সমাজের বোঝা নয় বরং সম্পদ এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা। আমরা জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কন্যা অটিস্টিক শিশুদের শিক্ষা এবং জীবন মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

তাই আমরা আশা করি তিনি অচিরেই এ বিষয়টির প্রতি মানবিক দৃষ্টি দিবেন। আজ কথা বলেছি আমার এলাকার এক ছোট ভাই শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে।

তাঁর বর্ণনা, “ছবিতে প্রতিবন্ধী ছেলেটির নাম নাসির, জন্মেছে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলাতে। কী অন্যায় সে করেছে যে কেউ তার কথা ভাবছে না! তার মতো হাজারও প্রতিবন্ধী এই উপজেলাতে রয়েছে অথচ তাদের জন্য কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা নেই।”

আমার ভাবনা থেকে এখন জাতির কাছে প্রশ্ন— এরা প্রতিবন্ধী বটে তবে একটু সহানুভূতি পেলে বা সবার সাহায্যের হাত বাড়ালে এরাও কিন্তু হতে পারে আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো।

জন্মে প্রতিবন্ধী বলে কর্মেও! ১৯৭১ সালে যাদের জন্মে বাবার ঠিকানা ছিল না, জাতির পিতা বলেছিলেন “আমি তোমাদের পিতা, আমার নাম এবং ধানমন্ডির বাডির ঠিকানা তোমাদের পরিচয়”।

জাতির পিতার মৃত্যুর পরে কে এমনটি প্রতিশ্রুতি দিতে পেরেছেন! মহম্মদপুর উপজেলা থেকে কেউ কি তাদের কথা ভাবতে পারে না? আমি বিষয়টি তুলে ধরতে চাই প্রিয় নেত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

কিছু করুন মহম্মদপুর উপজেলার প্রতিবন্ধীদের জন্য। এরাও তো স্বাধীন দেশের সাধারণ নাগরিক হিসাবে বাঁচতে চায়। এদেরও তেমনটি সুযোগ দিন যেমনটি দিয়েছেন ১৭ কোটি মানুষকে।

একটি শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এলাকাতে যাতে এরাও ডিজিটাল বাংলার সুযোগ সুবিধার মধ্য দিয়ে কর্মরত প্রশিক্ষণ পায় এবং নিজেদেরকে সোনার বাংলা গড়ার কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

এরাও যেন কর্মজীবন শেষে নিজেদের রোজগারে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে পারে। এমনটি স্বপ্ন নিয়ে তারা জীবন চলার পথ শুরু করুক। (যুগান্তর)

Share