কেবিন ক্রু মা, এমনিতেই সন্তানকে সময় দিতে পারতেন কম। তার ওপর বাবা কারাবন্দি। প্রিয় দু’জন মানুষ ছাড়া বেড়ে ওঠা হিয়ার জীবনে এমন অন্ধকার নেমে আসবে, তা কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। কিন্তু, মানুষ ভাবেন এক, সৃষ্টিকর্তা করে রাখেন আরেক। তাইতো মায়ের আদর-সোহাগ থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হলো তিন বছরের হিয়া। মা শারমিন আক্তার নাবিলা নেপালে দুর্ঘটনাকবলিত ইউএস-বাংলার ফ্লাইটের কেবিন ক্রু ছিলেন।
গত সোমবার দুপুরে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নামার সময় ইউএস-বাংলার ফ্লাইটটি (বিএস ২১১) রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে এবং তাতে আগুন ধরে যায়। এতে ৫১ জন আরোহী নিহত হন। বিমানটিতে চার ক্রুসহ ৩৬ জন বাংলাদেশি ছিলেন, যাদের মধ্যে ২৬ জন নিহত হয়েছেন।
এখনঅব্দি নাবিলার মরদেহ সনাক্ত হয়নি। তবে তার বিদায়ে গোটা বাড়ি শোকে পাথর হয়ে গেছে। কিন্তু, তাতে যেন কোনো রাঁ নেই হিয়ার। ফার্মগেটের নাখালপাড়ার বাসায় আপন মনে খেলছে সে।
মাঝেমধ্যে স্বজনদের কান্না দেখে কান্না করলেও মায়ের কথা জানতে চাইলেই হিয়া জবাব দিচ্ছে, ‘আম্মু বাসায় নেই, অফিসে গেছে।’
নাবিলার মৃত্যুর পর নানা পারিবারিক টানাপোড়েন শেষে হিয়ার আশ্রয় হয়েছে দাদি হাজেরা বিবির কাছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে নাখালপাড়ার সেই বাসায় গিয়ে দেখা মেলে হিয়ার।
সেখানে সে চাচাতো বোন বিভা, ভাই মুক্ত ও মুগ্ধের সঙ্গে খেলছিল। খেলার ফাঁকেই পরিবর্তন ডটকমের এই প্রতিবেদকের দু’একটি কথার জবাবও দেয় সে।
তোমার আম্মু কোথায়- জানতে চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিয়ার সরল উত্তর, ‘আম্মু নেই। বাসায় নেই। অফিসে গেছে।’
এরই ফাঁকে হাতে থাকা চকলেটগুলো খেলার সাথীদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে হিয়া। মেতে উঠছে দুষ্টামিতে। আর আপন মনে মোবাইলে গেম খেলছে।
স্বজনদের কেউ কেউ কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে, চুমু দিয়ে আদর করছেন। তারা নিজেদের আবেগকে ধরতে রাখতে পারছেন না, কান্নায় চোখ ভেজাচ্ছেন।
বেশিরভাগ সময় ছোট্ট হিয়া বেড়ে উঠেছে দাদি, ফুফু, চাচার আদর নিয়ে। সেটিই এখন তার জীবনের চিরন্তন হতে চলেছে। মায়ের আদর-সোহাগ আর কখনো পাওয়া হবে না তার।
এদিকে, হিয়ার বাবা হাসান ইমাম বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে কাশিমপুর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বলে তার ভাবী ফাতেমা হোসেন পরিবর্তন ডটকমকে জানিয়েছেন।
কারাগারে বসেই তিনি স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদ পান। এরপর থেকে হাসান ইমাম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। স্ত্রীর শোকে কান্নাকাটি করছেন বলে তার বোন লিপি পরিবর্তন ডটকমকে জানান।
নাবিলার লাশ আনতে যাওয়া হাসান ইমামের ভাই বাবলু কাঠমুন্ডু থেকে বলেন, ‘নাবিলার মরদেহ এখনো সনাক্ত হয়নি। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কেউই এখনো মরদেহ দেখতে পারেননি। অধিকাংশের দেহ আগুনে ঝলসে গেছে, মুখ দেখে তাদের চেনার উপায় নেই।’
হাসান ইমামের পরিবারের সদস্যরা জানান, নাবিলার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পরপরই হিয়াকে নানী নিয়ে যান। পরে পুলিশের মধ্যস্ততায় দাদির কাছে ফেরত দেয়া হয়েছে।
ইউএস-বাংলার সিনিয়র কর্মকর্তা মঞ্জুরুল বৃহস্পতিবার দুপুরে নাবিলার শ্বশুরের বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি নাবিলার জীবনের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় স্বামীর পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করেন।
নাবিলার সঙ্গে তার সর্বশেষ কথার বিষয়ে মঞ্জুরুল বলেন, ‘গত সপ্তাহে নাবিলার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। তখন তিনি বলেছিলেন- স্যার আমার জন্য দোয়া করবেন।’
জানা যায়, ইউএস-বাংলার বিমানটির ফ্লাইট পাইলট ছিলেন, আবিদ সুলতান, কো-পাইলট পৃথুলা রশীদ, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট খাজা হুসাইন মুহাম্মদ সাফে ও কেবিন ক্রু ছিলেন শারমিন আক্তার নাবিলা। তারা সবাই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৫: ২০ পি.এম ১৬মার্চ,২০১৮শুক্রবার
এ.এস