মা ইলিশ সংরক্ষণের অংশ হিসেবে আগামি ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত প্রধান প্রজনন মৌসুমে এ ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের ওয়েবসাইট সূত্রে শুক্রবার (৩১ আগস্ট) চাঁদপুর টাইমস এ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। এ সময় ইলিশ ধরা ও বিক্রির পাশাপাশি সরবরাহ, মজুদও নিষিদ্ধ থাকবে। এ আদেশ অমান্য করলে কমপক্ষে ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদ- বা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয়দ- হতে পারে।
ইলিশের নিরাপদ প্রজননের লক্ষ্যে চাঁদপুর,লক্ষ্মীপুর,নোয়াখালী,ফেণী,চট্টগ্রাম,ভোলা,কক্সবাজার,বরিশাল, বরগুনা,পটুয়াখালী,পিরোজপুর,ঝালকাঠি,বাগেরহাট,
শরীয়তপুর,বি.বাড়িয়া,ঢাকা,মাদারীপুর,ফরিদপুর,রাজবাড়ি,জামালপুর,নারায়ণগঞ্জ,নরসিংদী,মাণিকগঞ্জ,মুন্সিগঞ্জ,খুলনা, কুষ্টিয়া এবং রাজশাহী জেলার সব
নদীতে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে।একই সঙ্গে সমুদ্র উপকূল এবং মোহনায়ও ইলিশ ধরা যাবে না।
প্রজনন মৌসুমে প্রজনন ক্ষেত্রের পাশাপাশি দেশব্যাপি ইলিশ আহরণ,বিপণন,ক্রয়-বিক্রয়,পরিবহন,মজুদ ও বিনিময় নিষিদ্ধ এবং দেশের মাছঘাট, মৎস্য আড়ৎ,হাটবাজার, চেইনশপে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এনহ্যান্স কোস্টাল ফিরারিজ ইন বাংলাদেশ প্রকল্পের ইলিশ মাছ ব্যবস্থাপনা কর্ম পরিকল্পনার এক গাইড লাইন রিপোর্ট সংস্করণে উল্লেখিত দেশের ৫ টি ইলিশের অভয়াশ্রমসমূহের মধ্যে রয়েছে চাঁদপুর জেলার ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত মেঘনা নদীর ১শ’ কি.মি, চর ইলিশা থেকে ভোলা জেলার চর পিয়াল পর্যন্ত মেঘনা নদীর শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কি.মি, ভোলা জেলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী জেলার চর রোস্তম পর্যন্ত তেঁতুলিয়া নদীর ১শ’
কি.মি,পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কি.মি এবং শরীয়তপুর জেলার নুরিয়া থেকে ভেদরগঞ্জ পর্যন্ত নিম্ম পদ্মার ২০ কি.মি. এলাকাকে সরকার ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে খ্যাত।
এ ছাড়াও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বরিশাল জেলার হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার লতা,নয়াভাঙ্গানী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থলে নতুনভাবে আরো ৬০ কি.মি.এলাকাকে ইলিশের ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে চাঁদপুর নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট এর এক সূত্রে জানা গেছে। এ সব অভয়াশ্রমের দৈর্ঘ্য হলো ৪শ’১০ কি.মি.।
প্রসঙ্গত ,নদ-নদীর দেশগুলোর মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম দেশ বাংলাদেশ। দেশের এ নদ-নদীতে ইলিশ উৎপাদন দিন দিন বাড়ছেই। এদেশে বহু প্রকারের মাছ রয়েছে। এর মধ্যে ইলিশের অবস্থান সর্বশীর্ষে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে মিঠা পানির উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ৪র্থ। দেশে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হচ্ছে তার বর্তমান মূল্য হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
চলতি বছর ২০১৭-১৮ তে ইলিশ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিলো ৪ লাখ মে.টন। মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষা করার ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা যথাযথভাবে পালিত হলে ইলিশ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অতীতকাল থেকেই আমাদের জাতীয় অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং আমিষের চাহিদা পুরণে ইলিশ মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। দেশের মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইলিশের অবদান ১২%।
২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন ইলিশ উৎপন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে। ইলিশ আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ।
বাংলাদেশের মাছ প্রধানত: দু’ভাগে বিভক্ত। এর একটি হলো লোনা পানির মাছ অপরটি হলো মিঠা পানির মাছ। আর দেশের জাতীয় মাছ হলো ইলিশ। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের সাম্প্রতিক তথ্য মতে,বিশ্বের ১১ টি দেশে ইলিশ রয়েছে।এর মধ্যে ১০টি দেশেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। আর বাংলাদেশে এর উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বের ৬৫% ইলিশ বাংলাদেশেই উৎপাদন হচ্ছে।
ইলিশ মাছ সাগরে বসবাস করে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মেই বংশ বিস্তারের জন্যে ডিম ছাড়ার সময় ১২শ’ কি.মি.পর্যন্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের মিঠা পানিতে প্রবেশ করে। একটি মা ইলিশ একবারে ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ে। যার ৯৮% ইলিশের রেণুতে পরিণত হয়ে খাদ্যের প্রয়োজনে উজানে চলে আসে। উজান থেকে ধেয়ে আসা পানির ভেতর থাকে প্লাংটন নামক এক প্রকার বালু কণিকা যা তাদের খাদ্য। যে সব এলাকাগুলোতে ডিম ছাড়ার সময় ইলিশ আসে বা বিচরণ করে ওইসব এলাকাগুলোকেই ইলিশের অভয়াশ্রম বলা হয়।
প্রতি বছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৫ শ’ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই এ মাছের চাহিদা রয়েছে। কেননা এটি একটি সু-স্বাদু মাছ। সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ ইলিশ উৎপাদন হয়ে থাকে তার ৬৫% বাংলাদেশে,২০% ভারতে, ৫% মায়ানমারে এবং বাকি ৫% ভাগ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পাওয়া যায় । প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের দেশের নদ-নদীগুলোতে ইলিশের বিচরণ রয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, ইলিশ বিভিন্ন সময় স্বাদু পানি, লবণাক্ত ও আধা লবণাক্ত পরিবেশে কাটায়। তবে ডিম পাড়ার সময় হলে বঙ্গোপসাগড়ের মেঘনা মোহনায় এসে স্বাদু বা মিঠা পানিতে প্রবেশ করে। ডিম ছেড়ে পুনরায় লবণাক্ত পানিতে চলে যায়। এটি ইলিশের জীবনধারা ।
চাঁদপুর নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইলিশ গবেষক ড.আনিছুর রহমান চাঁদপুর টাইমসকে জানিয়েছিলেন ,‘ ২০১৭-’১৮ অর্থবছরে দেশের সকল ইলিশ উৎসসমূহে ৪ লাখ মে.টন ইলিশ উৎপাদনের সম্ভাবনা। জাটকা রক্ষা কর্মসুচি, মা মাছ সংরক্ষণে অভয়াশ্রম সুরক্ষা বিদ্যমান থাকলে এ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।’
প্রতিবেদক : আবদুল গনি
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩:৩০ পিএম,৩১ আগস্ট ২০১৮,শূক্রবার
এজি