ফিচার

ছেলের কাছে বৃদ্ধাশ্রম থেকে লেখা মায়ের করুণ পত্র

প্রিয় সোনামানিক!
বিশ্বাস করি, মায়ের দোয়া সর্বক্ষণ যার সাথে থাকে তার অনিষ্ট করার শক্তি শয়তানেরও নাই। নিশ্চয়ই স্ত্রী, পুত্র-কন্যা নিয়ে সুখে আছ। তুমি শান্তিতে থাকলে পৃথিবীর যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি খুশি সেটা তোমার এই বৃদ্ধ মা। আমিও খুব ভালো আছি তবে শরীরের কমজোরী স্বাক্ষী দিচ্ছে, বোধহয় বেশিদিন থাকা হবে না তোমাদের শহরের কাছাকাছি। অনেকদিন তোমাকে না দেখতে দেখতে তোমার ছবিখানা ঝাপসা হয়ে গেছে। অবশ্য এটা আমার দুর্বল দৃষ্টিশক্তির দোষ। তবে ভেবোনা কেননা তোমার মায়ের হৃদয়ের সবটা জুড়ে শুধু তোমার ছবিখানাই অঙ্কন করা। তারপরেও খুব ইচ্ছা করে, শেষ যাত্রার আগে তোমাকে একটি বার দেখতে, তোমার মাথায় হাত রাখতে। খোকা! কেমন আছিস ? মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এটা জিজ্ঞাসা করতে। এখানে আমার প্রতিবেশীরা যখন জিজ্ঞাসা করে আপনার ছেলে তো বিশাল অফিসার, শহরের নামকরা ব্যক্তি, ধণ-দৌলতের অভাব নাই, তারপরেও আপনি কেন বৃদ্ধাশ্রমে ? জানিস খোকা! তোমার দুর্নাম হয় এমন কিছুই তাদের কাছে বলিনা। আমার মস্তিষ্ক আমার সাথে গোয়ার্তুমি করলেও এই একটি ব্যাপারে উত্তর দিতে সে বেশ সক্রিয়তার ভূমিকায় থাকে। হেসে হেসে বলি, বৃদ্ধ বয়সে একটু নিভৃতে খোদাকে ডাকবো বলেই এই আড়ালো আসা। তাছাড়া আমার খোকা আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। তার ধ্যনা-জ্ঞানের সবটুকু জুড়েই আমি। তোমার ব্যস্ততার কারনে হয়ত তুমি ফোন করার সময় পাওনা তবে আমি ওদের সামনে গিয়ে ফোনটাকে কানের কাছে ধরে প্রতিদিন তোমার সাথে কথা বলার অভিনয় করি। মিছি-মিছি জিজ্ঞাসা করি, খোকা আমাকে নিয়ে তুই এত ভাবিস কেন ? আমি খুব ভালো আছি। তোমার কণ্ঠস্বর শোনার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি। আমার শ্রবনশক্তির সৌভাগ্য হয়না বহুদিনের পরিচিত তোমার কণ্ঠ ধ্বনির ছোঁয়া পাওয়া। এতবার মা ডাকের স্বাক্ষী হওয়া। তারপরেও কাউকে বুঝতে দিই না, আমার খোকা আমার থেকে দূরে আছে।
…..
বাপ আমার! তোর সেই ছোট বেলায় একবার আমার ভীষন অসুখের সময় তোকে তোর দাদীর কোলে রেখে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। ডাক্তার সাহেবের আসতে দেরি হচ্ছিল দেখে, তোর চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার দেহের ব্যথার চেয়েও তোকে রেখে সৃষ্ট শুণ্যতার ব্যথায় মনটা পুড়ছিলো বেশি। সুস্থতার ভাণ করে ডাক্তার না দেখিয়েই আমাকে বাসায় নিয়ে আসতে তোর বাবাকে বাধ্য করেছিলাম। তুই যখন ইস্কুলে থাকতি, কোথাও বেড়াতে যেতি তখন মুহুর্তের জন্য তুই চোখের আড়াল হলেই কেঁদে বুক ভাসাতাম। উচ্চশিক্ষার জন্য যেদিন তুই আমাকে ছেড়ে গিয়েছিছি সেদিন থেকে তুই বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত মাছ-গোশত কিংবা ভালো খাবারের স্বাদ কেমন হয় তা ভুলেই যেতাম। তোর বাবা অনেক বকাবকি করতো কিন্তু সেটা নিষ্ফল ছিলো। তোকে ছাড়া আমার শুণ্যতার শেষ ছিল না, সময় কাটাতে পারতাম না। তুই যখন আলাদ বিছানায় শুইতে শিখলি, তারপর থেকে প্রতিদিন গভীর রাতে একবার তোকে দেখে আসতাম। শীতে শরীর থেকে কাঁথা পড়ে গেলে ঠিক করে দিতাম, গরমে বসে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম। তোর জন্মের পর দীর্ঘ বছরেও যখন আর মা হইনি তখন তোর বড় চাচী টিটকারী করে বলতো, আরেকটা সন্তান নিচ্ছো না কেন ? তোমার আদরের খোকা যদি তোমার বৃদ্ধ বয়সে তোমার দেখভাল না করে তখন কোথায় আশ্রয় নেবে ? এসব শুনে কখনো মনে অন্য চিন্তা প্রবেশ করেনি বরং সবটা জুড়েই সর্বক্ষন কেবল তুই ছিলি। বিশ্বাস কর খোকা, তোর আদরের ভাগে কেউ ভাগ অংশীদার হোক সেটা কোনভাবেই মানতে পারছিলাম না। তোর বাবার বহু আব্দারকে তোর কথা ভেবে উপেক্ষা করেছি। আমার অসহায় সময় তুই আমার দেখা-শুণা করবি তার বিনিময়ে তো তোকে ভালোবাসিনি। মনের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করেই তোকে আগলে রেখেছিলাম আমার সামর্থ্যের দিনগুলো পর্যন্ত। আজ আমার অসহায় দিনগুলোতেও আমার সবটা জুড়ে কেবল তোর বাস। বৃদ্ধ বয়সে কি না কি বলে ফেলছি। বাবা ! রাগ করিস না।
….
মানিক আমার ! বউমার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখবি। ওকে আমার ঘরে আনার সময় ওর বাবা-মাকে কথা দিয়েছিলাম আমার মেয়ে হয়েই থাকবে। আমি তো আগলে রাখতে পারলাম না। আমার যোগ্য সন্তান হিসেবে তুই আমার হয়ে দায়িত্বটুকু পালন করে দিস। দাদুভাই-দিদামনির খুব যত্ন করিস। ওদের কোন আব্দার অপূর্ণ রাখবি না। সন্তানের প্রতি এ আমার আদেশ।

ওদের কোন আব্দার যদি অপূর্ণ থাকে তবে তোমার অসহায় সময় ওরা তোমাকে কথা শোনালে সেটা আমার সন্তানের ব্যর্থতা হিসেবেই আমার মনে হবে।

আমি চাইনা, আমার সন্তানের কোন প্রকারের ব্যর্থতা থাকুক। তোমাকে পূর্ণ করেই তৈরি করেছিলাম। তুমিও তোমার সন্তানদের পূর্ণ হতে সাহায্য করো। ভবিষ্যত খুব নিষ্ঠুর হয়রে বাবা। বর্তমানের আশা ভবিষ্যতে নিরাশায় পরিণত হয়। কাজেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাবধান থেকো।

কলিজার টুকরো আমার! খুব তাড়াতাড়ি হয়ত আমার কায়িক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। তাই বলে ভেবোনা, আমার আশীর্বাদের ছায়া তোমার মাথার ওপর থেকে সরে যাবে।

বিশ্বাস করো, প্রভূর কাছে আমার জন্য যতবার জান্নাত চেয়েছি তার চেয়ে হাজার বার বেশি কামনা করেছি, যাতে আমার সোনামানিক, কলিজার টুকরা সুখে-শান্তিতে, নিরাপদে থাকে।

প্রভূর সাধ্য নাই, সন্তানের জন্য মায়ের মঙ্গলকামনাকে কবুল করা থেকে বিরত থাকার। বিশ্বাস রেখো, কালের স্রোতে আমি হারিয়ে গেলেও আমার রব তোমার শুভ-অশুভ দেখার দায়িত্ব নিবেন।

সর্বদা ভালো থেকো, আমার বংশধরদের ভালো রেখো। বৃদ্ধাশ্রমে আছি বলে একবারও ভেবোনা আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট।

বরং পৃথিবীর অন্য মায়েরা তাদের সন্তানের প্রতি যতটা খুশি আমি তার চেয়ে তোমার ওপর বহুগুন বেশি সন্তুষ্ট। জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তোমার মায়ের পরিচয়ে বাঁচবার অধিকার তো আমি পেলাম!

এটাই বা ক’জন পায়? মৃত্যুর পরে তোমার বাবার কবরের পাশে আমাকে শায়িত করো। আর কি চাইবো? মা তো সন্তানের কাছে চাইতে পারে না বরং দিতে পারে। আমি আমার ভালোর সবটুকু তোমাকে দিয়ে গেলাম।
….
তোমার গর্ভধারীনী মা।
….
রাজু আহমেদ। কলামিষ্ট।
fb.com/rajucolumnist/

Share