মাহাকালের পাতায় বেগম খালেদা জিয়া
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁদের জীবন ও ভূমিকা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না। তাঁরা ব্যক্তি হিসেবে যেমন স্মরণীয়, তেমনি একটি যুগ, একটি প্রবণতা এবং একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক হয়ে ওঠেন। মরহুমা বেগম খালেদা জিয়া সেই বিরল শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত-যাঁর নাম উচ্চারিত হলে কেবল একজন রাজনীতিক নয়, বরং কয়েক দশকের টানাপোড়েন, সংগ্রাম, বিরোধ ও অনমনীয় অবস্থানের কথাই স্মরণে আসে।
তাঁর রাজনৈতিক জীবন সহজ ছিল না, মসৃণও ছিল না। বরং তা ছিল সংকটপূর্ণ, দ্বন্দ্বমুখর এবং ইতিহাসের কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে লড়াইয়ে পূর্ণ। এই দীর্ঘ পথচলায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আপোষহীন নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে-যে দৃষ্টান্ত সমর্থন ও সমালোচনা উভয়ই জন্ম দিয়েছে, কিন্তু কখনো উপেক্ষার সুযোগ দেয়নি।
সংগ্রামের রাজনীতি ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা:
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক পরিচয়ের কেন্দ্রে ছিল তাঁর দৃঢ়তা। সংকটের মুহূর্তে তিনি সহজ সমাধানের পথ বেছে নেননি। আপসের মাধ্যমে স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি অর্জনের চেয়ে তিনি দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। রাজনৈতিক চাপ, দমন-পীড়ন কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতি-কোনোটিই তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে সরিয়ে নিতে পারেনি।
এই দৃঢ়তা তাঁকে সমসাময়িক রাজনীতিতে একটি স্বতন্ত্র অবস্থানে নিয়ে যায়। ক্ষমতার প্রশ্নে নয়, বরং আত্মমর্যাদা, রাজনৈতিক অধিকার ও অবস্থানের প্রশ্নে তিনি ছিলেন অনমনীয়। এই অনমনীয়তা একদিকে যেমন তাঁর অনুসারীদের কাছে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, অন্যদিকে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধও সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো-এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অনিবার্য নাম করে তুলেছে।
সময়ের প্রতিচ্ছবি:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া কেবল একজন দলীয় নেত্রী হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তিনি হয়ে উঠেছিলেন একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। একটি প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনা, আন্দোলন ও নতুন সংগ্রাম গড়ে উঠেছে তাঁর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে। গণতন্ত্র, ক্ষমতার ভারসাম্য, রাজনৈতিক অধিকার ও রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে যে আলোচনা ও সংঘাত-তার বড় অংশেই তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে।
এই সময়টি ছিল জটিল ও বহুমাত্রিক। রাজনীতি ছিল সংঘাতপূর্ণ, সমাজ ছিল বিভক্ত, এবং রাষ্ট্র কাঠামো ছিল চাপের মুখে। এই বাস্তবতার মধ্যেই তিনি নিজের রাজনৈতিক পরিচয় নির্মাণ করেছেন। সহজ পথে নয়, বরং কণ্টকাকীর্ণ পথেই তাঁর পদচারণা ছিল স্পষ্ট ও দৃঢ়।
বিদায়ের দিনে ইতিহাসের সাক্ষী:
মরহুমা বেগম খালেদা জিয়ার বিদায়ে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে ব্যতিক্রমী ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে দেশের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিবের ইমামতিতে অনুষ্ঠিত জানাযা ছিল শুধু একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি ছিল জাতির সম্মিলিত শ্রদ্ধা ও স্মরণের প্রকাশ। ইমামের কণ্ঠে উচ্চারিত দোয়ার সঙ্গে মিশে ছিল অসংখ্য মানুষের নীরব প্রার্থনা, দীর্ঘশ্বাস ও আবেগ।
ওলামা, স্কলার, আলেম-আরেফ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে এই জানাযা রূপ নেয় এক অভূতপূর্ব জাতীয় সমাবেশে। এই সমাবেশের তাৎপর্য ছিল এর বহুমাত্রিকতায়। এখানে উপস্থিত ছিলেন ভিন্ন মত ও ভিন্ন অবস্থানের মানুষ-যাঁরা এই বিদায়ে একত্রিত হয়েছিলেন একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে।
বিভাজনের ঊর্ধ্বে এক ক্ষণ:
এই বিদায়ের দৃশ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে-রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে শোক ও শ্রদ্ধায় একাত্ম হওয়ার ক্ষমতা এখনো সমাজে বিদ্যমান। মতপার্থক্য সত্ত্বেও কিছু মুহূর্ত আছে, যখন ব্যক্তি ছাপিয়ে ইতিহাস সামনে চলে আসে। এই জানাযা ছিল তেমনই একটি মুহূর্ত।
এটি ছিল কেবল একজন নেত্রীর শেষ যাত্রা নয়; বরং একটি যুগের মূল্যায়নের নীরব উপলক্ষ। এখানে ব্যক্তি বেগম খালেদা জিয়ার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে তাঁর রাজনৈতিক জীবন, তাঁর অবস্থান এবং তাঁর প্রভাব। এই উপলব্ধি রাজনীতির বাইরে গিয়েও একটি মানবিক সত্যকে সামনে নিয়ে আসে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব:
এই বিদায়ের দৃশ্য দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোচনার জন্ম দেয়। বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একটি জাতি কীভাবে তার প্রভাবশালী নেত্রীকে বিদায় জানায়-এই প্রশ্নের উত্তর মিলেছে এই ঘটনায়।
এই প্রেক্ষাপটে বিদায়টি রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে মানবিক ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। এটি দেখিয়ে দেয়, মতভেদ থাকা সত্ত্বেও শ্রদ্ধা ও স্মরণের একটি সর্বজনীন ভাষা রয়েছে, যা সময়ের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ইতিহাসে অবস্থান:
ইতিহাস কখনো তাৎক্ষণিক রায় দেয় না। সময়ের প্রবাহে, পুনর্মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই ইতিহাস তার সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। মরহুমা বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পাঠ, গবেষণা ও বিতর্কের বিষয় হয়ে থাকবে।
কেউ তাঁকে দেখবে অনমনীয় নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে, কেউ দেখবে সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির ময়দানে প্রজ্ঞার প্রতিচ্ছবি হিসেবে। কিন্তু একটি বিষয় অনস্বীকার্য-তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন এক চরিত্র, যাঁকে বাদ দিয়ে এই ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ হয় না।
উত্তরাধিকার ও স্মৃতি:
রাজনৈতিক উত্তরাধিকার কেবল ক্ষমতার হিসাব নয়; এটি মূল্যবোধ, অবস্থান এবং সময়ের ওপর প্রভাবের সমষ্টি। বেগম খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকার এই দৃষ্টিকোণ থেকে বহুমাত্রিক। তাঁর জীবন ও সংগ্রাম ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রশ্ন করতে শেখাবে-আপোষ ও অবস্থানের সীমা কোথায়, রাজনীতিতে দৃঢ়তা কতটা প্রয়োজন, এবং ইতিহাস কীভাবে ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করে।
এই প্রশ্নগুলোই তাঁকে সমসাময়িক রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে ইতিহাসের আলোচনায় স্থায়ী করে রাখবে।
মহাকালের পাতায় অমলিন নাম:
মাহাকালের দীর্ঘ ধারায় কিছু নাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিতর্ক, মতভেদ ও সমালোচনার আবরণ পেরিয়ে তারা ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী জায়গা করে নেয়। মরহুমা বেগম খালেদা জিয়া সেইসব নামের একজন।
এই বিদায় কোনো চূড়ান্ত সমাপ্তি নয়; বরং এটি একটি অধ্যায়ের ইতি টেনে নতুন করে মূল্যায়নের সূচনা। সংগ্রাম, দৃঢ়তা ও আপোষহীন অবস্থানের প্রতীক হিসেবে তাঁর নাম মহাকালের পাতায় লেখা থাকবে-নীরবে, সংযতভাবে, কিন্তু গভীর ও স্থায়ীভাবে।
মুসাদ্দেক আল আকিব
লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী