ফিচার

‘মাল’ নিয়ে অভিনেতা আহসান কবিরের রম্যরচনা

এক ইন্ডিয়ান আর এক চাইনিজ মন খারাপ করে বসেছিল। এক বাংলাদেশি এসে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে জানতে চাইলো- এই তোদের মন খারাপ কেন?

কান্না কাতর ভাব নিয়ে বসে আছিস কী কারণে? ইন্ডিয়ানটা বললো- জানিস আমার দাদীমা মারা গেছেন। চাইনিজটা বললো- আমার গ্রান্ডফাদারও তুলনামূলক অল্প বয়সে মারা গেছেন। বাংলাদেশিটা একটু ভেবে বললো- ইন্ডিয়ান আর চাইনিজ মালের এই এক সমস্যা। বেশিদিন টেকে না!

‘সুখ’ নাকি চাইনিজ ‘মাল’। বেশিক্ষণ টেকে না। ‘দুঃখ’ নাকি জাপানিজ! দুঃখের টিকে থাকার ক্ষমতা অসাধারণ।

অবশ্য তেলাপোকারও টিকে থাকার ক্ষমতা আছে। শরৎচন্দ্র লিখেছিলেন- অতিকায় ডাইনোসর লোপ পাইয়াছে কিন্তু ক্ষুদ্রাকায় তেলাপোকা টিকিয়া আছে। বাংলাদেশে ইদানিং ‘মাল’ এর জয়জয়াকার সর্বত্র।অবশ্য ছোটকাল থেকে অনেকের মতো আমার জীবনটাও খানিক ‘মাল’ময় ছিল।
ছোটকালে কোনও একদিন রিক্সায় চড়ে যাচ্ছিলাম। সাথে ছিল আমার চেয়ে বয়সে বড় এক সুন্দরী কাজিন। হঠাৎ একটা ছড়া ভেসে এলো কানে। আহা! ‘মালটা’ যে খাসা/ কোথায় তোমার বাসা? পাড়ার সবচেয়ে বখাটে ছেলের এই কদর্য ছড়া শুনে আমার কাজিন রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা থামাতে বললেন। এরপর রিক্সা থেকে নেমে রাম এক চড় বসালেন ওই বখাটের গালে। ছোটকালে দেখা এই ঘটনাটা আজও চোখে লেগে আছে। ঢাকা শহরে প্রথম এসেও ‘মাল’ শব্দটা থেকে বের হতে পারিনি। লঞ্চ থেকে নেমেই সদরঘাট। সামান্য দূরে বাংলা বাজার। বাংলা বাজারে দাঁড়িয়ে দেখলাম ট্রাক থেকে জিনিসপত্র আনলোড হচ্ছে। একজন বলছে- ওই মালগুলো যত্নে নামা। সব হুমায়ূনের মাল! একটু পরে বুঝলাম হুমায়ূনের মাল কী জিনিস। হুমায়ূন আহমেদের বই!

এরপর আমার মতো সবার জীবনে ‘মাল’ কেমন কেমন করে যেন একটা স্থায়ী জায়গা করে নিলো।বাস আর ট্রেনে কিংবা স্টেশনে লেখা থাকতো- মাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। কেউ ভালো কিছু করলে প্রশংসা করে তাকে এখনও বলা হয়ে থাকে ‘ও একটা মাল!’ কেউ কেউ নিজ সম্পর্কে গর্ব করে বলে- আমি হচ্ছি এমন এক মাল যে কিনা ‘ওয়ান পিস মেইড’, কারিগর ডেড।’ অফিসের বস বা শিক্ষক কতখানি কড়া সেটি প্রকাশের ভাষাও আজকাল ‘মাল’ দিয়ে করা হয়। বলা হয়ে থাকে- কঠিন মাল!

যার টাকা আছে এলাকায় তার পরিচয় হয়ে যায় মালদার পার্টি হিসেবে।বিপরীতে কেউ কেউ পরিচিতি পায় রদ্দি মাল হিসেবে।এমন হতে হতে একদিন রাজনীতেও ‘মাল’ ঢুকে গেলো।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অন্তত দুই দশক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের নামের অ্যাদ্যাক্ষর ছিল ‘ম’ (মোস্তাফিজুর রহমান, মাহমুদুল হাসান, মহব্বত জান চৌধুরী, মতিন চৌধুরী)। তবে আলতাফ হোসেন চৌধুরী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি সব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘মাল’এর পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।

শিশু নওশীন গুলিবিদ্ধ হয়ে মরে যাওয়ার পর তার একটা উক্তি সারাদেশে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়। উক্তিটা ছিল- আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন! (হায়, সেক্ষেত্রে মানুষও একটা মাল!!)

অর্থনীতিকে কথিত টাটকা রাখতে গিয়ে খুব সাধারণ মানুষকে আজকাল পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া হচ্ছে! ২০১৭ সালের জুনে বাজেট ঘোষণার পর জানা গেলো মানুষের মাথার ওপর বসানো হচ্ছে পাপের কর!

বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা বেহাত হয় অথচ অপরাধী কে জানা যায় না। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট করে ধনিক শ্রেণির মানুষ তাতে কারও কোনও শাস্তি হতে দেখা যায় না। সারা পৃথিবীর ভেতর ব্যাংক কেলেঙ্কারির জরিপে বাংলাদেশের নাম খুব লজ্জার সাথে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।

তারপরও যে সাধারণ মানুষ এদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখেন সেটা তাদের বড় পাপ। তাই সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে পাপ কর। যারা প্রয়োজনে একবেলা না খেয়ে থাকেন, যারা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অফিস থেকে পাঁচ সাত কিলোমিটার রোদে হেঁটে বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় ফেরেন, মাথা গোজার ঠাঁই বা সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সঞ্চয় পত্র কেনেন, এখন থেকে সেই সব আমানতকারীদের ওপর করের বোঝা বাড়বে, ব্যাংকে মাত্র এক লাখ টাকা জমা রাখলেও কর দিতে হবে। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বা সুদের হার কমবে। বাংলাদেশের মেরুদণ্ড খ্যাত খুব সাধারণ মানুষ আর নিরাপদে টাকা রাখতে পারবে না। কিছু কিনতে গেলে কিংবা রেস্তোরায় খেতে গেলে তাদের বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে। এসি বাস, ট্রেন বা লঞ্চে চড়তেও তাদের বাড়তি টাকা গুনতে হবে। এদেশের খুব সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, বাজেটের নামে তাদের করের জালে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। পানি, গ্যাস কিংবা বিদ্যুতের দাম বাড়বে, পরিবহন ভাড়া বাড়ার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, নাভিশ্বাস উঠবে তাদের জীবন চালাতে। সাধারণ মানুষ ভাত কাপড়ে মরবে, ভালো থাকবে সুখে থাকবে ব্যাংক, হলমার্ক কিংবা শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির নায়করা। নতুন কোনও ড. ইউনূস হয়তো আবারো ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে আলোচনায় আসবেন, নোবেল প্রাইজ পাবেন। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং খাত কিছু হায় হায় কোম্পানি আবারও সাধারণ মানুষের ঘাড় মটকানোর পায়তারা করবে। অর্থমন্ত্রী আবুল ‘মাল’ আব্দুল মুহিত বলেছেন তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠতম বাজেট দিয়েছেন! আর পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের  নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ২০১৭ সালের ঘোষিত বাজেটকে দিনে দুপুরে ডাকাতি বলে অভিহিত করেছেন! বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী এবং মুজিব নগর সরকারের পুরোধা ব্যক্তিত্ব তাজউদ্দীন আহমেদের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ‘দুই হাতি যখন যুদ্ধ করে তখন হাতির পায়ের তলে পিষ্ঠ হয় দুর্বা ঘাস। কিন্তু ওই দুই হাতি যখন রমন করে তখনও ওই দুর্বাঘাসই পিষ্ঠ হয়’। আবুল ‘মাল’ আব্দুল মুহিতের জীবনের শ্রেষ্ঠতম বাজেটেও পিষ্ঠ হবে দুর্বাঘাস রূপী গরীব মানুষ কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্ত!

ইংল্যান্ড আমেরিকা কিংবা ভারতের মতো দেশে আয়কর আদায়ের রেওয়াজ আছে কিন্তু ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি কর বসানোর রেওয়াজ নেই! এবারের বাজেটে বড় আমানতকারীদের কিংবা কোটি টাকার মালিকদেরই সুবিধা দেওয়া হয়েছে, ছোট হিসাবকারী তথা গরিবদের ওপর বেশি কর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন ব্যাংক কেলেঙ্কারির চার হাজার কোটি টাকা বেশি কিছু না সেই অর্থমন্ত্রীই আবার বলছেন যারা একলাখ টাকা জমানোর ক্ষমতা রাখেন তারাই বড়লোক! বাংলাদেশে এখনও চেক বই, ব্যাংকের কার্ড, লেজার ফির জন্য মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। আফ্রিকার কিছু দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর খুব কম দেশেই এমন গলাকাটার রেওয়াজ আছে। হয়তো একারণেই এই বাজেট শ্রেষ্ঠতম বাজেট! সাধারণ মানুষ হয়তো একারণেই ফিরে যাবে মাটির ব্যাংকের কাছেই! কেউ কেউ ব্যাংকের পরিবর্তে সিন্দুককেই বেছে নেবে! পুরনো দিনের মতো নিজ নিজ মাল তারা আবার নিজ দায়িত্বে রাখা শুরু করবে! (বাংলা ট্রিবিউন)

লেখক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও অভিনেতা আহসান কবির।

নিউজ ডেস্ক
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৪: ০০ এএম, ৭ জুন ২০১৭, বুধবার
ডিএইচ

Share