হয়তো ছেলেটির ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ না করলে এই ঘটনা ঘটতো না। কিন্তু রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কেউ খারাপ ভাষা ও যা তা বললে কতক্ষণ সহ্য করা যায়? মার খেয়েছি তাতে দুঃখ নেই। কিন্তু প্রতিবাদটা তো করতে পেরেছি। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’ একইসঙ্গে কোথাও কেউ ইভটিজিং করলেই প্রতিবাদের আহ্বান জানান দুই বোন।
জমজ বোন ফারিহা হাবিব মীম ও আসওয়াদ হাবিব জীম দু’জনই বিসিআইসি কলেজের একাদশ শ্রেণির মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী। ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় বখাটে ছেলের দ্বারা নির্যাতনের শিকার দুই বোনর চেহারায় তখনও ভয়ের ছাপ, যেন দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরছে তাদের।
চলতি বছর মিরপুরের গার্লস আইডিয়াল স্কুল থেকে এ-প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হন তারা। ঘটনার বর্ণনা জানতে চাইলে জীম বলেন, ‘এগারোটা ১০ মিনিটে পরীক্ষা শেষে কলেজ থেকে বেড়িয়ে আমি আমরা দু’জন। বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যাই। একটি বাসে উঠতে গিয়ে উঠতে পারলাম না। পরের বাসের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলাম।’
জীম একটু থামলেন। বর্ণনা শুরু করলেন মীম। বলছিলেন, ‘‘আমি যখন অহনা নামে ওই দোকানটা পার হচ্ছিলাম, হঠাৎ আমার কানে এলো ‘এই যে ফার্মের মুরগী যাচ্ছে।’ আমি একটু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ছেলেটা আবার একটা খারাপ ভাষা বললো। আমি দাঁড়ালাম। তাকালাম ছেলেটার দিকে। ছেলেটি বলছিল, ‘ওই তুই আমার দিকে তাকায়্যা আছোস ক্যা? কী করবি আমারে?’ প্রত্যুত্তোরে আমি বললাম, ‘আমি কি কিছু বলেছি আপনাকে?’ ছেলেটি দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। মুখে আরও খারাপ ভাষা। আমি তখন চিৎকার করে উঠি।’’
মীম বলছিলেন, ‘ছেলেটি বাইরে এসে আমার মুখে হাত দিয়ে থাপ্পড় দেয়। আমি আবারও চিৎকার করে উঠি। আমার চিৎকার শুনে জীম দৌড়ে আমার কাছে আসে। জীম ছেলেটার কলার ধরে মারধরের কারণ জানতে চায়? এতে ছেলেটা আরও মরিয়া হয়ে ওঠে।’
মীমের কথা কেড়ে নিয়ে জীম বলতে শুরু করে, ‘ছেলেটি আমাদের দু’জনকে এলোপাথাড়ি কিল-ঘুষি দিতে থাকে। আমরা মাটিতে পড়ে যাই। চিৎকার করতে থাকি। ধস্তাধস্তি হয়। এরই মধ্যে অনেক লোকজন জড়ো হয়। আমরা চিৎকার করে মানুষের হেল্প চাই। কিন্তু এগিয়ে আসেনি। সবাই মোবাইলে আমাদের ছবি তুলতে ব্যস্ত।’ জীম বলেন, ‘বয়স্ক এক লোক বলে উঠেন পোলাইপানরা একটু শয়তানি করতেই পারে। তোমরা প্রতিবাদ করছ কেন? ঝগড়া লাগাইছো কেন? যাও বাড়ি যাও।’
‘সেই মুহূর্তে ফয়সাল নামে আমার এক বন্ধু এগিয়ে আসে। আরও দু-একজন বন্ধু এগিয়ে আসে। আমাদের সেভ করার চেষ্টা করে। কিন্তু ছেলেটি তাদেরও মারতে উদ্যত হয়। ছেলেটির পক্ষ নিয়ে কথা বলতে থাকে আশেপাশের সবাই।’— বলেন জীম।
জীম বলতে থাকেন, ‘আমরা পরিস্থিতি বেগতিক দেখে চলে আসি। ছেলেটাকে কেউ একজন হয়তো টেনে নিয়ে যায়। সঙ্গে মোবাইল নেই। কলেজে মোবাইল নেওয়া নিষেধ। কয়েকজনের কাছে মোবাইল চাইলাম। শেষে একজন এগিয়ে দিলেন।’ জীম বলতে থাকেন, ‘বাবাকে মোবাইলে ঘটনাটা জানানোর পরপর কলেজের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি। রাগে এবং ক্ষোভে মাথা হেট হয়ে আসছিল। এমন সময় দেখি আবারও সেই ছেলেটি একটি বাঁশ নিয়ে দৌড়ে আসছে। এসে কোনও কথা না বলে সোজা এলোপাথাড়ি মার শুরু করলো। একটা বাড়ি আমার পায়ে লাগলে আমি মাটিতে পড়ে যাই। মীমকেও পেটাচ্ছিল।’
মীম বলেন, ‘অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছিল। প্রথম দফা মারধরের পরও আমরা কেন কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করছি, বলছিল এসব কথাও। মুখে যা আসছিল তাই বলছিল ছেলেটি। এখানেও কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখছিল। কেউ ছেলেটিকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেনি।’
মীম বলে, ‘এ সময় ছেলেটির সঙ্গে আরও দু’টি ছেলে ছিল। তারাও মারতে উদ্যত হয়। কেউ একজন বলে বেশি মারিস না মরে যাবে। সেই মুহূর্তে কলেজের ভেতর থেকে অনেক বন্ধু-বান্ধব বেরিয়ে আসে। তারা কাছে আসতেই ছেলেটি বাঁশ হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, আমি মারছি। কী করবি তোরা? এরপর যখন আরও অনেকে এগিয়ে আসে। তখন ছেলেটি চলে যায়। পরে খবর পেয়ে সব শিক্ষকরাও ঘটনাস্থলে আসেন।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নায়েম-এ কর্মরত দুই ছাত্রীর বাবা আহসান হাবীব মেয়ে দুটো যে প্রতিবাদ করেছে তা নিয়ে গর্বিত। তিনি বলেন, ‘এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বখাটের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিক।’ আহসান হাবীব জানান, ‘শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব ফোন করে পাশে থাকবেন এবং বখাটের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। ফোন করেছিলেন স্থানীয় এমপি আসলামুল হকও। তিনিও বিষয়টিতে দুঃখ প্রকাশ করে বখাটের শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তারা পলাতক জীবন করিম বাবুকে ধরতে অভিযান চলছে বলেও জানিয়েছেন।’
বার্তা কক্ষ