চাঁদপুর হাইমচর উপজেলার আলোচিত শিশু শিক্ষার্থী মারজানা আক্তার (৯) হত্যার চার বছর আজ। ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর স্থানীয় ৩ বখাটে কতৃক ধর্ষণ শেষে নির্মমভাবে খুন করা হয় শিশু মারজানাকে। আলোচিত এই ঘটনাটি দীর্ঘ চার বছর পেড়িয়ে গেলেও বিচার পায়নি মারজানার পরিবার।
এই অমানবিক হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত চার বছরেও এজহারভূক্ত আসামী জালাল ও সিদ্দিককে আটক করতে পারেনি পুলিশ। আর নান্নু চৌকিদার ও সেলিম বেপারীকে আটক করা হলেও তারা জামিনে মুক্তি নিয় এলাকায় বীরদর্পে প্রকাশ্যে চলাফেরা করছে। আর মেয়ে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে মারজানার অসহায় পরিবার গ্রাম ছাড়া হয়ে শহরের পুরাণবাজারে আশ্রয় নিয়েছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, হাইমচর থানার ঈশানবালা এলাকার হতদরিদ্র মোকশেদ হাওলাদার বাজারে ট্রেইলাসের দোকান দিয়ে জীবিকানির্বাহ করেন। মোকশেদের ১ ছেলে ৩ মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে স্থানীয় চর কোড়ালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন। ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর বিকেল অনুমান সাড়ে ৫টায় মারজানকে বাজারের ব্যাগ ধরিয়ে ঈশানবালা বাজারে বাবার দোকানে পাঠায় তার মা।
বাজারে যাওয়ার পথে স্থানীয় চৌকিদার নান্নু চৌকিদার মারজানের মুখ চেপে ধরে জনৈক নাসির সর্দারের পরিত্যক্ত ঘরে নিয়ে যায়। এরপর সে’সহ দ্বীন ইসলাম হাওলাদারের ছেলে জালাল মিয়া হাওলাদার (২১), কাদির বেপারীর ছেলে সিদ্দিক (২২) ও শফিক উল্লাহ বেপারীর ছেলে সেলিমসহ ৪জন নরপশু জোরপূর্বক পালাক্রমে ধর্ষণ করে। মারজানের গোপনাঙ্গে রক্তের ধারা বয়ে যায়। জ্ঞান হারায় মারজান। জ্ঞান ফিরলে ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাবে- এই আশঙ্কায় ৪ পাষন্ড নরপশু গলা টিপে হত্যা করে মারজানকে।
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত শুরু হলেও মেয়ে বাড়ি ফিরে না আসায় সবাই এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। এক পর্যায়ে মৃত মারজানের উলঙ্গ প্রাণহীন দেহ পাওয়া যায় হাইমচর থানার ঈশানবালা এলাকায় মারজানের বাড়ির অদূরে নদীর পাড়ে। ধর্ষক ও হত্যাকরীরা এলাকার সুবিধাবাদী মহলের যোগসাজসে সুকৌশলে মারজানকে জ্বীনে মেরেছে বলে প্রচার করে। মারজানের মৃতদেহ দাফন করা হয় স্থানীয় কবর স্থানে।
আরও পড়ুন… ‘আমারে মাইরা ফেলুক, তবুও আমার বইনের হত্যাকারী গো ফাঁসি হোক’
কিন্তু হতভাগী মারজনের মা-বাবার মন কিছুতেই সায় দেয় না যে, তাদের আচঁলের নিধি মারজানকে জ্বীনে মেরেছে। মনকে কোনভাবেই বুঝ দিতে না পেরে মারজানের বাবা ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি, ঈশানবালা দ্বীন ইসলাম হাওলাদারের ছেলে জালাল মিয়া হাওলাদার (২১), কাদির বেপারীর ছেলে সিদ্দীক (২২) ও শফিক উল্লাহ বেপারীর ছেলে সেলিম গংদের আসামী করে মামলা করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদপুর এর আদালতে।
আদালত হাইমচর থানার ওসিকে সরাসরি মামলা রজুর আদেশ দিলে হাইমচর থানায় মামলা (নং ৪, তারিখ ১৬/০১/১৮ইং ধারা -৩০২/৩৭৬/২০১/ ৩৪/ ১০৯ দঃবিঃ) রুজু হয়। তদন্তভার দেওয়া হয় হাইমচর থানার এসআই সুমন মিয়াকে।
এক বছরেও মামলাটির তদন্তে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি না হওয়ায় তৎকালিন পুলিশ সুপার মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করেন। আইও নিয়োগ করা হয় ডিবির এসআই শামীম আহম্মদকে। এসআই শামীম বদলী সূত্রে অন্যত্র গেলে গত বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি এসআই রেজাউলকে মামলার তদন্ত ভার দেয়া হয়।
গোয়েন্দা পুলিশের এই চৌকস অফিসার মাত্র এক মাসের মধ্যে মামলার ঘটনায় সম্পৃক্ত এজাহার বহির্ভূত আসামী নান্নু চৌকিদারকে গ্রেফতার করেন শরীয়তপুর থেকে। জিজ্ঞাসাবাদে নান্নু সে নিজে’সহ এজাহার নামীয় ৩ আসামী মারজানকে নারকীয়ভাবে ধর্ষন ও হত্যার লোমহর্ষক বিবণে দেয় এবং আদালতে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়।

এরপর পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান পিপিএম (বার) এর দিকনির্দেশনা ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মিজানুর রহমানের সার্বিক সহযোগিতায় আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে গত ৭ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটনের টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকা থেকে এসআই রেজাউল করিমসহ সঙ্গীয় ফোর্স এজাহার নামীয় অন্যতম আসামী মোঃ সেলিম বেপারীকে গ্রেফতার করেন। পরে আটক সেলিমকে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদনসহ আদালতে প্রেরণ করা হলে সে স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দেয়। তবে আটকের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আলোচিত এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডেন আটক দুই আসামী নান্নু চৌকিদার ও সেলিম বেপারী আদালতে জামিন নিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান।
এদিকে শিশু মেয়ের ধর্ষণ ও তার হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে মারজানার অসহায় পরিবার এখন গ্রাম ছাড়া। আপরাধিরা জামিনে ছাড়া পেয়ে মারজানার পরিবারকে মামলা তুলে নেবার জন্যে নানাভাবে ভয়ভীতি আর হুমকি-ধমকি দিচ্ছি।এরই মধ্যে হতভাগা মারজানার কিশোর ভাই মারুফকে ধরো নিয়ে আটক সেলিমের বাবা শফিউল্লাহ বেপরী, বড় ভাই জলিল দলবলসহ বেদম প্রহার করে। তার হাত ভেঙ্গে দেয়।
গলা চেপে ধরে বলে ‘তোর বইনের খুনের মামলায় আমাগো ছেলের যদি ফাঁসি অয়, তইলে তোরেও আমরা মাইরা ফালামু’।
এক পর্যায়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় কিশোর মারুফ। বিষয়টি তাৎক্ষনাত চাঁদপরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রেজাউল করিমকে অবহিত করা হয়। এতে ইশানবালা ফাঁড়ির পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে দ্রুত ব্যাবস্থা নেয় পুলিশ প্রশাসন।
অসহায় বাবা মায়ের ভয় মেয়ের মতো তাদের কিশোর ছেলেকেও না জানি হত্যা করে মানুষরুপি হায়নার দল। তাই আসামীদের হাত থেকে বাঁচতে নিজের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ফেলে চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন।
এ বিষয়ে মারজানার হতভাগা পিতা মোকশেদ হাওলাদার বলেন, ‘ওরা আমার লেদা মাইয়াডারে খারাপ কাজ মাইরা ফালাইছে। চার বছরেও আমি বিচার পাইলাম না। চাঁদপুরের ডিসি একজন মা। আমি আমার মাইয়ার বিচারের জন্য ডিসি স্যারের দৃষ্টি স্যার, পুলিশ সুপার স্যার, আইনজীবী স্যারদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
উল্লেখ: এই ঘটনায় চাঁদপুরের তৎকালিন পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার পিপিএম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং মারজানার পরিবার ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেন। ওই সময়ে পুলিশ সুপার জানিয়েছিলেন অপরাধী যে হোক না কেনো দোষী প্রমানিত হলে তাদের শাস্তি পেতে হবেই।
প্রতিবেদক: আশিক বিন রহিম, ২২ ডিসেম্বর ২০২১
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur