প্রেমিক ভাগ্নে একাই একে একে ৫ জনকে খুন করে। এর মধ্যে ৪ জনকে পাটার শীল দিয়ে মাথায় আঘাত করে ও একটি শিশুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। প্রেমিক ভাগ্নে মাহফুজ পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
সে জানিয়েছে, কিভাবে মামীর সঙ্গে তার পরকীয়া হয়েছিল, কেনই বা এই নির্মম হত্যাকান্ডের পথ বেছে নিল সে?- আদালতে সবিস্তারে বর্ণণা করেছে ঘাতক মাহফুজ।
নারায়ণগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট সাইদুজ্জামান শরীফের আদালতে ১৬৪ ধারায় মাহফুজের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। জবানবন্দিতে মাহফুজ ওরফে ভাগ্নে মারুফ দিয়ে দুই শিশুসহ একই পরিবারের পাঁচজনকে হত্যার কথা স্বীকার করে।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সোয়া ৩টা পর্যন্ত এই জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
শরীফুল ইসলামের বড় বোন আছিয়া বেগমের ছেলে মাহফুজ। জবানবন্দিতে মাহফুজ বলেছে, “শরীফুল মামা ও মামী লামিয়া যখন গাজীপুরে থাকতেন তখনই মামীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়। মামীই আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছেন। নানাভাবে তার সঙ্গে সম্পর্ক করতে ভঙিমা দেখিয়েছেন। আর মামীর উষ্কানী আর ভঙিমাতে পা দিয়েই আজকে আমার এই অবস্থা। গাজীপুর থেকে মামা-মামী নারায়ণগঞ্জে চলে এলে আমিও চলে আসি। এখানে মামারা কয়েকজন একই বাসায় থাকতেন। শরীফুল মামা ও লামিয়া মামী ছাড়াও শফিকুল মামা, তাসলিমা মামী, তার ভাই মোরশেদুল, তাসলীমা মামীর ছেলে শান্ত ও মেয়ে সুমাইয়া একই বাসায় থাকতেন। একসঙ্গে এত লোক থাকায় মামীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার সুযোগ খুব একটা পাওয়া যাচ্ছিল না। আবার মোরশেদুলের ফ্যাক্টরিতে চাকরি নেয়ার কারণে কারখানা থেকে খুব বেশি বের হওয়া যেত না। তারপরও গোপনে গোপনে মামীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলাম।”
মাহফুজ জানায়, “১০/১২ দিন আগে মোরশেদুল আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি ধরে ফেলে। সালিশ-বিচারের নামে আমাকে জুতোপেটা করে। সেই থেকে মোরশেদুলসহ অন্যদের শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করি। গত ১৫ জানুয়ারি জানতে পারি শরীফুল ও শফিকুল মামা কেউই রাতে বাসায় ফিরবেন না। এটাকেই সুযোগ হিসেবে নেই। সন্ধ্যার পর গোপনে লামিয়া মামীর কক্ষে ঢুকে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকি। রাতে টিভি দেখে খাওয়া দাওয়ার পর দুই মামী তাসলিমা মামীর কক্ষে শুয়ে পড়েন। আর লামিয়া মামীর কক্ষে এসে ঘুমায় মোরশেদুল। রাত ১২টার দিকে মোরশেদুল ঘুম ভেঙে বাথরুমে যেতে গিয়ে খাটের নিচে আমাকে ধরে ফেলে। রাতে কিছু না বলে সেখানেই ঘুমাতে দেয়। রাত ৩টার দিকে মোরশেদুল ঘুমিয়ে পড়লে আমি কিচেন থেকে পাটার শীল নিয়ে আসি।”
মাহফুজের ভাষ্য অনুযায়ি, “শীল দিয়ে প্রথমে মোরশেদুলের মাথায় আঘাত করে। এরপর লেপ মুখে চাপা দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে সেখানে ভালো করে ঢেকে রাখি। ভোর পর্যন্ত কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায় না। ৭টার দিকে শান্ত ঘুম থেকে উঠে স্কুলে চলে যায়। তখন তাসলিমা মামীকে বলি মোরশেদ মামা আপনাকে ডাকছে? তিনি ঐ ঘরে আসতেই শীল দিয়ে মাথায় আঘাত করি। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লে গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করি। এরপর লামিয়া মামীর ঘরে গিয়ে দেখি তিনি শুয়ে নড়াচড়া করছেন। তার মাথায় আঘাত করতেই তিনি সরে যান। তবে আহত হন। এক পর্যায়ে লামিয়া আমাকে উল্টো শীল ছুড়ে মারলে সেটি সুরাইয়ার উপর গিয়ে পড়ে। এতে সুরাইয়া আহত হয়। পরে আবারও শীল দিয়ে মারি লামিয়াকে। এরপর লামিয়ার গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করি। পাশাপাশি সুমাইয়া চিত্কার শুরু করলে তাকেও গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করি।”
মাহফুজ আরো জানায়, “সকাল সাড়ে ৭টার পর শান্ত হঠাত্ করেই বাসায় ফিরে আসে। দরজা খুলতেই রক্ত দেখে সে চিত্কার করে ওঠে। তখনই শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করি। সব কাজ শেষে হাত পা ধুয়ে কারখানায় চলে আসি। সেখানে গোসল করার পর শুয়েছিলাম। সেখান থেকেই পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।”
এছাড়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট এইচ এম শফিকুল ইসলামের আদালতে মাহফুজের ছোট ভাই মারুফ, মোর্শেদুল ওরফে মোশারফের কারখানার কর্মচারী রাসেল, নয়ন, লাভলু ও নজিমুল ১৬৪ ধারায় সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়। নারায়ণগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক হাবিবুর রহমান এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
নারায়নগঞ্জের পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন গতকাল এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, মাহফুজ আগে থেকেই ঘরের খাটের নিচে ওঁত্ পেতে ছিল। একে একে সে ৫ জনকে হত্যা করে।
চাঞ্চল্যকর এই পাঁচ খুনের ঘটনায় শনিবার রাতেই ঘটনাস্থল থেকে মাহফুজকে আটক করে পুলিশ। এরপর সোমবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয় জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। পুলিশ সুপার বলেন, নৃশংস এই হত্যাকান্ডের মাত্র ৫ দিনের মাথায় সব রহস্য উদঘাটন করা হল।
এ পর্যন্ত হত্যাকান্ডে ব্যবহূত সব আলামত জব্দ করা হয়েছে। সবাইকে হত্যার পর বাসায় তালা মেরে যে চাবিটা ফেলে দিয়েছিল মাহফুজ, সেটিও উদ্ধার করা হয়েছে।
নিউজ ডেস্ক ।। আপডেট : ১:৪৭ এএম, ২৩জানুয়ারি ২০১৬, শনিবার
ডিএইচ