শাহজাহান শাওন :
গত তিন মাসের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়ের করা মামলায় দ্রুত চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। এ সব মামলায় দলের সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি তরুণ নেতাদের নামে ব্যাপকহারে চার্জশিট প্রদান করা হচ্ছে।
আটক নেতাদের গণহারে রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ ‘নির্যাতন’ করছে। একই সঙ্গে রিমান্ডে নিয়ে বিএনপির রাজনীতি না করার জন্যও চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপির। অপেক্ষাকৃত তরুণ ও দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় নেতাদের নামে পুলিশের এ গণহারে চার্জশিট প্রদান ও দ্রুত বিচারের দিকে নিয়ে যাওয়া, রাজনীতি ছাড়তে চাপ দেওয়াকে সক্রিয় নেতৃত্ব ধ্বংসে সরকারের হিসেবী কর্মকাণ্ড বলে অভিযোগ করছে বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মিথ্যা মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের জড়িয়ে যেভাবে দ্রুতগতিতে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে, দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমি মনে করি এটা বিএনপিকে ভাঙা ও নেতৃত্বশূন্য করার সরকারের আরেকটি অপচেষ্টা। আমরা বিষয়টিকে মোটেও ভালভাবে দেখছি না। আমরা সরকারের এ চেষ্টাকে মনে-প্রাণে ঘৃণা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের এ প্রক্রিয়ার কারণে আমাদের দলের যে পুনর্গঠন প্রচেষ্টা তা অবশ্যই ব্যাহত করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের মধ্যে দিয়ে যে গণতন্ত্রের বাতাবরণ, সরকার মিথ্যা মামলায় বিরোধী দলের নেতাদের শাস্তি দেওয়ার যে নীলনকশা আঁকছে, তাতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হল। আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণে প্রচেষ্টাতেও নতুন করে ধাক্কা লাগল।’
সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা কোনো দাগী ক্রিমিনাল নন। তারা রাজনীতির জন্যই, রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্যই আসামী। সরকারের উচিত এ সব না করে দেশের গণতন্ত্রকে একটি শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে দেওয়া। না হলে দেশ ও জনগণের জন্যই তা অমঙ্গল।’
দলীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের শুরুর দিন থেকে টানা তিন মাসের সরকারবিরোধী আন্দোলনে সারাদেশে কয়েক লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ২০ হাজারেরও বেশী মামলা হয়েছে। শুধু ঢাকা মহানগরে খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৪ হাজারেরও বেশী মামলা হয়েছে। এরমধ্যে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইনে।’
বিএনপির অভিযোগ, বিরোধী দলকে অন্যায়ভাবে দমনের জন্য সরকার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে মিথ্যা মামলাকে ব্যবহার করছে। বিএনপির আরও অভিযোগ, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহিংসতার মামলায় পুলিশকে দ্রুত চার্জশিট দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। তার নির্দেশের পর থেকে চার্জশিট দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে।
সুপ্রীমকোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীদের আন্দোলন প্রশ্নে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সরকার মামলার অপপ্রয়োগ করছে। তাদের উদ্দেশ্য নেতাকর্মীদের মামলা ও নির্যাতনের ভয়-ভীতি দেখিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। একই সঙ্গে বিএনপিকে দুর্বল করে নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত রাখা।’
বিএনপির আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘গত ৬ বছর ধরেই মিথ্যা মামলায় হয়রানি করে বিএনপির নেতাকর্মীদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার অপচেষ্টা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও সরকার। এটা নতুন কিছু নয়। কথায় কথায় রিমান্ডে নিয়ে নেতাকর্মীদের নির্যাতন করা হয়। দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার কথা বলা হয়। কিন্তু নেতাকর্মীরা শত নির্যাতনের মুখেও কখনও পরাজয় স্বীকার করে না।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে দিন চার্জশিট দেওয়ার জন্য বলেছে, সেদিন থেকেই দ্রুত গতিতে চার্জশিট আসছে। শুধু তরুণ নেতৃত্বই নয়, দলের সিনিয়র নেতাদেরও জ্বালাও-পোড়াওয়ের মিথ্যা মামলায় চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে। এতে করে সরকার পার পাবে না। দেশ থেকে হরণকৃত গণতন্ত্র যতক্ষণ পর্যন্ত না পুনরুদ্ধার হচ্ছে-ততক্ষণ পর্যন্ত বিএনপির শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন বন্ধ হবে না। বিএনপি অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে। আমরা রাজপথে ও আইনী লড়াই চালিয়ে যাব।’
সানাউল্লাহ আরও বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হচ্ছে। তারা যাতে জামিন না পান সেজন্য বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) ধারায় মামলা দেওয়া হয়। অথচ বিএনপির নেতাকর্মীরা কোনো নাশকতা, জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়।’
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে সহিংসতার অভিযোগে সারা দেশে কয়েক লাখ নেতাকর্মীর নামে নাশকতা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মামলা হয়েছে। এ মামলার সংখ্যা বিশ হাজারের বেশী। শুধু ঢাকাতেই মামলা হয়েছে সাড়ে ৪ হাজারের বেশী। এ সব মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সদস্য এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, বরকতউল্লাহ বুলু, রুহুল কবির রিজভী, মহানগর বিএনপির তরুণ সদস্য সচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, বিএনপির সহ ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের ভূইয়া জুয়েলসহ বিপুলসংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন।
বিএনপির অন্যতম আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন মেজবাহ বলেন, ‘রিমান্ডে নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত তরুণদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার, শারীরিক নির্যাতন করা হয়। বিএনপি, বিএনপির নেতৃত্ব, বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কেও বিভিন্ন কটূক্তি করা হয়। কেন এখনও তারা বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে— এ সব বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়। রিমান্ড ফেরত নেতাকর্মীদের কাছ থেকে এ সব তথ্য আমরা জানতে পারি।’
মেজবাহ আরও বলেন, ‘পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পেলেই তার নামে চার্জশিট দেওয়ার আইনী নিয়ম। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে চার্জ গঠন করা হচ্ছে তাতে পুলিশ কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারছে না। এ সব দেওয়া হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। কারণ তিনি কিছুদিন আগে পুলিশকে কড়া ভাষায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে মামলার চার্জ দ্রুত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই এখন যে চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে তা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই দেওয়া হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিনিয়র নেতাদের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত তরুণ বেশীরভাগ নেতাদের নামেই চার্জগঠন করা হচ্ছে। যাতে এ সব নেতারা ভবিষ্যতে বিএনপির আরও নেতৃত্বে এসে দলকে আরও সুসংগঠিত করতে না পারেন।’
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগমীর ৭৮টি মামলার আসামী। তিনি গত ৬ জানুয়ারি থেকে কারাগারে রয়েছেন। বর্তমানে তার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৭৩টি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে ১৪টি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহর বিরুদ্ধে ৮টি, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে ৫টি, সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে ১৪টি, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ৫টি, কারাগারে থাকা চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুর বিরুদ্ধে ১৭টি, আব্দুল আউয়াল মিন্টুর বিরুদ্ধে ৫টি, শমসের মবিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৪টি, বর্তমানে কারাগারে মোসাদ্দেক আলী ফালুর নামে ৪টি, যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে ৭১টি, বর্তমানে শিলংয়ে বিচারাধীন সালাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ২৭টি, বর্তমানে কারাগারে রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে ৪৪টি, বরকতউল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে ৪৫টি, এ ছাড়াও চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের নামে ৪৭টি, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুকের বিরুদ্ধে ১০টি, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর নামে ৪০টি, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে ১১০টি, সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম নীরবের বিরুদ্ধে ১১৮টি, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিবুব উন নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধ ১০০টি, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপুর বিরুদ্ধে ১০৫টি, বিএনপির সহ ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ১৩৭টি, যুবদল মহানগর (উত্তর) সভাপতি রফিকুল আলম মজনুর বিরুদ্ধে ১০৬, বিএনপির গণ-শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার বিরুদ্ধে ২টি, ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলের বিরুদ্ধে ১০১টি, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবীবের বিরুদ্ধে ৯৮টি মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত।
বিশেষ ক্ষমতা আইনে অভিযুক্তের অভিযোগ প্রমাণ হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। আর এ আইনের মামলার আসামী সাধারণত জামিন পান না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরে ১১৫৯টি মামলায় আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ। এর বেশীরভাগই বিশেষ ক্ষমতা আইনে।
শনিবার, ১৩ জুন ২০১৫ ০১:৫৫ অপরাহ্ন
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/ এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।