সংশোধন করা হচ্ছে ‘মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আইন’। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ণ এবং যুগের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে নতুনরূপে তৈরি করা হয়েছে এ বোর্ডের আইনটি। এটি অনুমোদন পেলে দীর্ঘ ৪১ বছরের পুরানো ইংরেজিতে প্রণিত আইন রহিত করা হবে।
সংশোধিত ও পরিমার্জিতভাবে বাংলায় তৈরি করা প্রস্তাবিত খসড়া আইনে বোর্ডের স্থায়ী কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স দেশের অন্যান্য বোর্ডের ন্যায় ৬০ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের সার্বিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণে ‘বোর্ড’ কমিটির পরিবর্তে নতুন নাম ‘পরিচালনা’পর্ষদ’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং এর সদস্য সংখ্যা ১৩ জনের বিপরীতে করা হয়েছে ১৫ জন। ওই পরিচালনা পর্ষদে রেজিস্ট্রারকে নতুন করে ‘সদস্য-সচিব’ করা হয়েছে। আর বিদ্যমান ৪৩টি ধারার পরিবর্তে প্রস্তাবিত খসড়া আইনে কমিয়ে করা হয়েছে ৩০টি ধারা।
খসড়া আইনে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইন, ২০১৮ অনুযায়ী পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, উন্নয়ন, নবায়ন, নিরীক্ষণ এবং সংস্কার কাজে এনসিটিবি কে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে বলে একটি নতুন ধারা সংযোজন করা হয়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার মান ও যোগ্যতা নির্ধারণে বিশেষ বিধান যুক্ত করা হয়েছে খসড়ায়। নতুন আইনের ফলে মাদ্রাসা বোর্ড সরকারের অনুমতিক্রমে বৈদেশিক উৎস হতে অনুদান গ্রহণ করতে পারবে। এমন সব সংশোধনীসহ খসড়া আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এটি আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠার কথা রয়েছে। আইনটির নাম দেয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আইন-২০১৯’।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ রোববার বলেন,` দীর্ঘ ৪১ বছরের পুরানো ইংরেজিতে তৈরি করা এ আইনে বেশ কিছু জায়গায় ত্রু টি-বিচ্যুতি ছিল। যুগের চাহিদার প্রেক্ষিতে বিদ্যমান আইনটি সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। স্টোকহোল্ডারদের মতামত নিয়ে সংশোধনীতে বিভিন্ন বিষয় বাদ দেয়ার পাশাপাশি নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। সম্পূর্ণ বাংলায় তৈরিকৃত পরিমার্জিত খসড়া আইনটি অনুমোদনের জন্য একটি সারসংক্ষেপ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি মন্ত্রিসভার পরবর্তী বৈঠকে আইনটি অনুমোদন পাবে।’
মন্ত্রিসভার জন্য পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড আইন সংশোধনী সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রস্তাবিত খসড়া আইনে বোর্ডের স্থায়ী কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়স সরকারি কর্মচারীদের ন্যায় ৫৯ বছর প্রস্তাব করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড আইন, ২০১৮ এবং দ্য ইন্টারমেডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১- এ বোর্ডের স্থায়ী কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের বয়সসীমা ৬০ বছর। সেই আলোকে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের স্থায়ী কর্মচারীদের এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে বলে সারসংক্ষেপে সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর কায়সার আহমেদ গতকাল রোববার সন্ধ্যায় বলেন,` যেহেতু সাধারণ ৯টি ও আরেকটি কারিগরি বোর্ডের স্থায়ী কর্মচারীদের অবসরের বয়স ৬০ বছর, সেহেতু আমার বোর্ডের কর্মচারীরাও সেটি পাওয়ার যৌক্তিকতা আছে। আমি এর পুরপুরি সমর্থন করি। এখন বাকি সিদ্ধান্ত সরকারের।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ‘মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য মাদ্রাসা এডুকেশন অর্ডিন্যান্স-১৯৭৮’র ক্ষমতাবলে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৯ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপ পায়। সামরিক সরকার আমলের সকল অধ্যাদেশ উচ্চ আদালত বাতিল করায় ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে’র অস্তিত্ব বিলুপ্তির মুখে পড়ে।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন আইন-২০১১ এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের ফলে ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল এবং ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জারি করা অধ্যাদেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধিভুক্ত কোনো অধ্যাদেশ থাকলে, তা আইনে রুপান্তর করার জন্য দ্রুত উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়।
এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় অন্যান্য দফতরের মতো দ্রুত এ আইনের খসড়া তৈরি করে। আগের অধ্যাদেশের সংশোধন ও পরিমার্জন করে আইনটি বাংলায় রূপান্তর করে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মতামতও নেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, বর্তমানে মাদ্রাসা বোর্ডে মোট চারটি উইং রয়েছে। চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন শাখা,জেডিসি, দাখিল ও আলিম স্তর পর্যন্ত পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাখা’, মাদ্রাসাগুলোর দেখভালের জন্য রয়েছে ‘পরিদর্শন শাখা’ এবং ‘প্রকাশনা শাখা’।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড হচ্ছে- দেশের আলিয়া পদ্ধতির ইবতেদায়ী, দাখিল ও আলিম স্তরে পাঠদানের অনুমতি ও একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদান, স্বীকৃতির মেয়াদ বৃদ্ধি নবায়ন এবং বিভাগ-বিষয় খোলা। এ স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ম্যানেজিং কমিটি, গভর্ণিং বডি, নির্বাহী কমিটি, এডহক কমিটি অনুমতি ও অনুমোদন এবং কমিটি সংক্রান্ত উদ্ভ‚ত জটিলতা নিরসন। ।
বিদ্যোৎসাহী সদস্য মনোনয়ন (ফাজিল ও কামিল স্তর); সিলেবাস ও কারিকুলাম প্রণয়ন, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পাঠ্যসূচি নির্ধারণ এবং পাঠ্যপুস্তক রচনা করা; আপীল অ্যান্ড আরবিট্রেশন; শিক্ষার্থীদের নাম রেজিস্ট্রেশন, রেজিস্ট্রেশন কার্ড প্রস্তুতকরণ ও বিতরণ; জেডিসি, দাখিল ও আলিম স্তরের পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণ, প্রবেশপত্র প্রস্তুতকরণ ও বিতরণ; পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ এবং সনদপত্র বিতরণ ও পরীক্ষা সংক্রান্ত ইত্যাদি বহুমুখী কার্যক্রম সম্পন্ন করা এ বোর্ডে অন্যতম কাজ। এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম বৃহৎ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান।
আইন অনুসারে, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রধান চেয়ারম্যান। মাদ্রাসা বোর্ড আগে পরিচালিত হতো ১৩ সদস্যের একটি বোর্ড কমিটির মাধ্যমে। তবে প্রস্তাবিত খসড়া আইনে ‘বোর্ড’ শব্দের পরিবর্তে ‘পরিচালনা পর্ষদ’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এবং এর সদস্য সংখ্যা ১৫জন থাকবে। চেয়ারম্যান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হবেন। এ পর্ষদে নতুন করে রেজিস্ট্রারকে সদস্য সচিব হিসেবে যুক্ত করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশে ‘পরিচালনা পর্ষদ’-এর সভা ডাকবেন পর্ষদের সদস্য সচিব। প্রতি তিন মাস অন্তর পরিচালনা পর্ষদের সভা করতে হবে। চেয়ারম্যান এ সভার সভাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করবেন এবং তাহার অনুপস্থিতিতে সভায় উপস্থিত সদস্যগণের মধ্যে থেকে নির্বাচিত একজন সদস্য পর্ষদের সভাপতিত্ব করবেন। পরিচালনা পর্ষদের কোরামের জন্য ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতি থাকতে হবে; তবে মুলতুবি সভার ক্ষেত্রে কোনো কোরামের প্রয়োজন নেই।
নতুন খসড়া আইনে চেয়ারম্যান মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সংস্থাটির কার্যবালী ও সিন্ধান্ত বাস্তবায়ন, হিসাবসংরক্ষণ, হিসাববিবরণী প্রণয়ন ও তা নিরীক্ষা করবেন। চেয়ারম্যান বোর্ডের কার্যবালী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন মতে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে অস্থায়ীভাবে বোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত মেয়াদের জন্য শ্রমিক নিয়োগ করতে পারবেন।
এ বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যিনি নিয়োগ পাবেন তাহার চাকরির মেয়াদ ও শর্তবালি সরকার স্থির করে দেবে। চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিত, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে চেয়ারম্যান তাহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, শূন্যপদে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান তাহার পদে যোগদান না করা পর্যন্ত সরকার কর্তৃক মনোনীত কোনো ব্যক্তি সাময়িকভাবে চেয়াম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, যিনি বোর্ডের রেজিস্ট্রার থাকবেন, তিনি অনূন্যত ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তাদের মধ্যে হতে প্রেষণে নিয়োগ পাবেন। রেজিস্ট্রার বোর্ডের সার্বক্ষণিক কর্মচারী হবেন যিনি চেয়ারম্যানের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদের সভার তারিখ, সময় এবং আলচ্যসূচি নির্ধারণ, সভার কার্যবিবরণী প্রস্তুত, বোর্ডের কার্যবালীর বিবরণ ও সংশ্লিষ্ট নথি সংরক্ষণ ।
বোর্ড নির্দেশিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন ও কার্য সম্পাদন করিবেন। জানা গেছে, মাদ্রাসা বোর্ডে বর্তমানে অনুমোদিত প্রথম শ্রেণির পদ রয়েছে ৩৫টি। আর দ্বিতীয় শ্রেণির ১১টি, তৃতীয় শ্রেণির ১০২টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ৪৪টি পদ রয়েছে।
বার্তা কক্ষ , ২৬ নভেম্বর ২০১৯
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur