তদন্তকারি কর্মকর্তার চরম গাফিলতির কারণেই মাত্র ৫ বছর ৮ মাস বয়সের শিশু (বর্তমানে ৮ বছর) খাইরুল আমিনকেই হতে হলো মাদক মামলার আসামি। পুলিশের হাতে ধরা পড়া সরোয়ার আলম নামের এক মাদক কারবারি তার নাম গোপন রেখে পুলিশকে দেয় আপন চাচাত ভাই কিশোর খাইরুল আমিনসহ তার বাবার নাম।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাও এসব যাচাই বাছাই না করে অভিযোগপত্র দিয়ে পঠিয়ে দেয় আদালতে। এরই মধ্যে মূল আসামি সরোয়ার আলম জামিনে বেরিয়ে যায় জেল থেকে। তার স্থলে অভিযোগপত্রে নাম আসে আপন চাচাত ভাই কিশোর খাইরুলের। মাদরাসা ছাত্র কিশোর খাইরুলই এখন মাদক মামলার আসামি হয়ে আদালতে আসা-যাওয়া করছে। খাইরুলের পিতা শামশুল আলমের অভিযোগ-তদন্তকারী কর্মকর্তা পলাতক আসামি সরোয়ারের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েই তার শিশু পুত্রকে আসামি বানিয়ে দিয়েছে।
এদিকে সেই তদন্ত কর্মকর্তা (মামলার আইও) মহেশখালী থানার উপপরিদর্শক বিকাশ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালতের নির্দেশ থাকলেও তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। আর আদালতের এমন নির্দেশনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার।
২০১৪ সালের ৯ আগস্ট রাতে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম খোন্দকার পাড়া জামে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ এক অভিযান চালিয়েছিল। সেই অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছিল জ্যরিকেন ভর্তি ৮০ লিটার চোলাই মদ। মহেশখালী থানা পুলিশের অভিযানে চোলাই মদের সঙ্গে আটক করা হয় ৬ জন মাদক কারবারিকেও।
পুলিশের হাতে আটক হওয়া এই ৬ মাদক কারবারির সঙ্গে ৫ বছর ৮ মাস বয়সের শিশু খাইরুল আমিন না থাকলেও থানার মাদকের মামলায় শিশুটির নামও আসামি কলামে রেকর্ড করা হয়। এমনকি পরবর্তীতে মামলার অভিযোগ পত্রেও তুলে দেওয়া হয় শিশুটির নাম। সেই থেকে গত ৪ বছর ধরেই এই শিশুটি থানা আদালতে ছুটছে মাদক মামলার আসামি হিসাবে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবারও কৃষক পিতা শামসুল আলমের হাত ধরে মহেশখালী দ্বীপ থেকে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজিরা দিতে আসে কিশোর খাইরুল আমিন।
মহেশখালী থানার উপ-পরিদর্শক মো. আবু জাফর ৮০ লিটার চোলাই মদসহ ৬ কারবারিকে আটকের পর নিজেই বাদী হয়ে মহেশখালী থানায় মামলাটি (জিআর-২৪৮/১৪) দায়ের করেন। মামলার আসামিরা পরস্পর যোগসাজসে একটি সিএনজি ট্যাক্সি নিয়ে চোলাই মদ পাচার করছিল। মামলার আসামিরা হচ্ছে যথাক্রমে আকতার কামাল (২৯), সিএনজি চালক মাহবু আলম (৩২), খাইরুল আমিন (২০), নুরুল আবছার (১৯), আবদুর করিম (২০) ও রেজাউল করিম (২০)। তারা সবাই মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী ও বড় মহেশখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা।
বর্তমানে চাঞ্চল্যকর মাদক মামলাটির অধিকতর তদন্ত চলছে। মহেশখালী থানা পুলিশ চোলাই মদসহ ৬ জন কারবারিকে আটকের পর এক মাসের মধ্যেই মামলার চার্জশীট প্রদান করে। মামলা বিচারের জন্য কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানোর পরই পলাতক আসামি হিসাবে শিশু খাইরুল আমিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়।
গত বছরের ২৪ এপ্রিল মহেশখালী থানা পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মূলে খাইরুলকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েই হতবাক হয়ে পড়েন। কেননা খাইরুলের বয়স যেখানে ২০ উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে গিয়ে দেখেন বাস্তবে খাইরুল হচ্ছে একজন শিশু। একই দিন আদালত থেকে জামিনে মুক্তি লাভ করেন খাইরুল। এরপর থেকেই এখনো হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে কিশোর খাইরুল তার পিতার সঙ্গে আদালতে এসে।
কক্সবাজারের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর পরিদর্শক নাজমুল হক কালের কণ্ঠকে জানান, ‘মাদরাসায় পড়ুয়া কিশোর খাইরুলকে দেখে আদালতের বিচারকও বিব্রত হয়ে পড়েন। এ কারণে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন।’ পিবিআই পরিদর্শক নাজমুল জানান, তিনি মামলাটির অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে ইতিমধ্যে মহেশখালী দ্বীপের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রাথমিক তদন্তে তিনি জানতে পারেন, খাইরুলের জেঠাত ভাই সরোয়ার আলম (২০) চোলাই মদসহ পুলিশের হাতে আটক হবার পরই নিজের নাম গোপন রেখে আপন কিশোর চাচাত ভাই খায়রুলের নাম রেকর্ড করায়।
ইত্যবসরে মাদক মামলাটির আসল আসামি সরোয়ার আলম জেল থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে পলাতক হয়ে পড়েন। কোনো তদন্ত এবং ছাড়াই মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক বিকাশ চক্রবর্তী পলাতক আসামি সরোয়ার আলমের বদলে অভিযোগ পত্রেও কিশোর খাইরুলের নাম লিপিবদ্ধ করে দেন। গত ৫ মার্চ ২০১৮ ইং তারিখ মামলার বিচারিক আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ মীর শফিকুল আলম মামলার তদন্তে এরকম চরম গাফিলতির জন্য তদন্তকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই সঙ্গে মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশনা দেন পিবিআইকে।
এ বিষয়ে শিশু খাইরুলের পিতা মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী গ্রামের উত্তরকুল গ্রামের বাসিন্দা কৃষক শামসুল আলম বলেন, ‘যখন মামলাটি দায়ের করা হয় আমি তখন মধ্যপ্রাচ্যে ছিলাম। আমারই বড় ভাই মোহাম্মদ আলমের পুত্র সরোয়ার আলম মদসহ ধরা পড়ার পর নিজের নাম গোপন রেখে আমার পুত্র খাইরুলের নাম বলে দেয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার ভাতিজার নিকট থেকে বড় অংকের ঘুষ নিয়ে এ রকম ঘটনা করেছে।’ তিনি বলেন, তার ভাতিজা নিজের নাম গোপন রেখে চাচাত ভাইয়ের নাম দিয়ে কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পেলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা কোনো যাচাই-বাছাই পর্যন্ত না করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এ বিষয়ে পলাতক আসামি সরোয়ার আলমের স্ত্রী নাছিমা বেগম কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন, ‘আমার স্বামী বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। একটি মামলায় চাচাত ভাইয়ের নাম দিয়ে সে নিজেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এখন। জেলা থেকে আসার পর বেশ কিছুদিন ঘরে ছিল কিন্তু এরপরই পালাতক হন তিনি।’ কক্সবাজার পিবিআই’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তিনি মামলার অধিকতর তদন্ত তদারকি করছেন। তিনি জানান, মাদক মামলার সহযোগী আসামিরাও ইতিমধ্যে স্বীকার করেছে যে, তারাও জানত পলাতক আসামি মিথ্যা পরিচয় দেওয়ার বিষয়টি কিন্তু তারা ভয়ে বলেননি।
বর্তমানে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা মহেশখালী থানার সাবেক উপপুলিশ পরিদর্শক বিকাশ চক্রবর্তী বহাল তবিয়তে নোয়াখালীর কবিরহাট থানায় রয়েছেন বলে জানা গেছে। তদন্তকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। কক্সবাজারের রিজার্ভ পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরও) উপ-পরিদর্শক বাপ্পী সূত্র ধর কালের কণ্ঠকে এমন তথ্য দিয়েছেন। আরও’র প্রদত্ত বিকাশ চক্রবর্তীর মোবাইল নম্বরে আজ শুক্রবার বিকালে কয়েকবার রিং দিয়েও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
এদিকে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. এ কে এম ইকবাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে এ বিষয়ে জানান, ‘মহেশখালী থানার সেই মামলাটির ব্যাপারে তিনি অবহিত নন। এমনকি আদালতের এ রকম নির্দেশনা নিয়েও তিনি জানেন না।’
বার্তা কক্ষ