দেশজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে আরো ১১ জন নিহত হয়েছে। সোমবার দিবাগত রাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার ভোরের মধ্যে ৯ জেলায় পৃথক এসব ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে কুমিল্লা ও নীলফামারীতে দুজন করে মোট চারজন এবং চুয়াডাঙ্গা, নেত্রকোনা ও দিনাজপুরে একজন করে তিনজন নিহত হয়েছে। আর র্যাবের গুলিতে চট্টগ্রাম, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জে নিহত হয়েছে চারজন। কুমিল্লায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুজনকে। প্রায় প্রতিটি ঘটনায়ই বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ উল্লেখ করে এসব ঘটনার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা মোটামুটি একই ধরনের।কুমিল্লা : পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কুমিল্লায় পিয়ার মিয়া (২৪) ও শরিফ (২৬) নামে দুই মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। গুলিবিদ্ধ হয়েছে আরেক মাদক বিক্রেতা। সোমবার দিবাগত রাতে সদর উপজেলার অরণ্যপুর বড় দিঘিরপাড়ে এ ঘটনায় চার পুলিশ সদস্যও আহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি রিভলবার, গুলি, পাজেরো গাড়ি ও মাদক উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন ইমনের নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশ ও কোতোয়ালি পুলিশের একটি দল সোমবার বিকেলে শহরের শুভপুর এলাকা থেকে মাদক কারবারি পিয়ার মিয়াকে গ্রেপ্তার করে। তার দেওয়া তথ্য অনুসারে পুলিশ রাত সাড়ে ১২টায় অরণ্যপুরের বড়পুকুরের পশ্চিমপাড়ে তল্লাশিকালে একটি পাজেরো জিপকে থামার সংকেত দিলে গাড়ি থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। পুলিশের পাল্টা গুলিতে পিয়ার আলীসহ তিনজন আহত হয়। তাদের হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন। গুলিবিদ্ধ চাঁদপুরের শাহরাস্তির সেলিমকে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন ইমন জানান, পিয়ার আলীর বিরুদ্ধে মাদক নিয়ে বিরোধের জেরে একটি হত্যাসহ ১৩টি মামলা রয়েছে। আর শরিফের বিরুদ্ধে রয়েছে পাঁচটি মামলা।
একই রাতে দেবীদ্বারে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আহত অবস্থায় সাদ্দাম নামে এক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সোমবার মধ্যরাতে উপজেলার জাফরাবাদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
নীলফামারী : সৈয়দপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। গতকাল ভোরে গোলাহাট বধ্যভূমি এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে এ ঘটনা ঘটে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন জানান, নিহত ওই দুই মাদক কারবারি হলো সৈয়দপুর পৌর শহরের ইসলামবাগ এলাকার শাহীন (২৮) ও নিচু কলোনি এলাকার জনি (২৩)। এ সময় তিন পুলিশ সদস্যও আহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি মোটরসাইকেল, তিনটি ককটেল, পাঁচটি দেশীয় ধারালো অস্ত্র ও ১০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় মাদক কারবারি জনি ও শাহীনকে আটক করার পর তাদের নিয়ে মাদক কারবারি জসিয়ার রহমান ও নূর বাবুকে গ্রেপ্তার এবং লুকিয়ে রাখা মাদকদ্রব্য উদ্ধারে অভিযান চালায় পুলিশ। গোলাহাট বধ্যভূমি এলাকায় গেলে ওৎ পেতে থাকা তাদের সহযোগীরা পুলিশের ওপর হামলা করে। এ সময় দুপক্ষে গোলাগুলি শুরু হলে জনি ও শাহীন আটক অবস্থা থেকে পালিয়ে যায়। পরে জনি ও শাহীনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
নেত্রকোনা : পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নেত্রকোনায় আমজাদ হোসেন নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। পুলিশের দাবি, সে মাদক কারবারি। তবে নিহতের পরিবার বলছে, আমজাদ ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিল। জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম মনিরুজ্জামান দুদুও তাকে জেলা ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে উল্লেখ করেন।
পুলিশের বক্তব্য, মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে সোমবার গভীর রাতে আমজাদকে তার বাসা থেকে আটক করে পুলিশ। পরে তাকে নিয়ে সদর উপজেলার বড়ওয়ারি বালু মহাল এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার করতে গেলে সংঘবদ্ধ মাদক কারবারিরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ পাল্টা গুলি চালালে আমজাদ নিহত হয়। এ সময় পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুল আলম বলেন, অভিযানে হেরোইন, ৩০৫ পিস ইয়াবা, একটি পাইপগান ও দুটি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
আমজাদের ভগ্নিপতি আলমগীর জানান, সোমবার বাড়িতে হানা দিয়ে আমজাদ ও তার ছোট ভাই মনিকে তুলে নিয়ে যায়। পথে মনিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমজাদ কোনো দিন সিগারেটও খায়নি। বিএনপির রাজনীতি করার কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম : র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে চট্টগ্রামে শুক্কুর আলী (৪৫) নামে এক মাদক পাচারকারী নিহত হয়েছে। সোমবার মধ্যরাতে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ডেবারপাড় জামতলায় এ ঘটনা ঘটে। র্যাব ঘটনাস্থল থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা, একটি ওয়ান শ্যুটারগান, তিন রাউন্ড গুলি ও ৫০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করেছে। নিহত শুক্কুর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মুকুন্দপুর গ্রামের হেলাল উদ্দিনের ছেলে।
র্যাব-৭-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মিমতানুর রহমান জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মাদক উদ্ধার অভিযান শুরুর পর মাদক পাচারকারী টের পেয়ে গুলি ছোড়ে। র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়লে মাদক পাচারকারীরা পিছু হটে। পরে ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় র্যাবের দুজন সদস্য আহত হয়।
ফেনী : গতকাল ভোরে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ফেনীতে মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু (৪৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। র্যাবের দাবি, নিহত মঞ্জু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার রূপকানিয়া গ্রামে।
র্যাব-৭-এর অধীন ফেনীর ক্রাইম প্রিভেনশন কম্পানির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, র্যাবের একটি দল গতকাল ভোরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জেনিথ পেট্রল পাম্পের সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি শুরু করে। এ সময় একটি মাইক্রোবাসকে থামার নির্দেশ দিলে গাড়িটির ভেতর থেকে র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। র্যাব পাল্টা গুলি চালানোর পাশাপাশি গাড়িটি ধাওয়া করে। পরে লেমুয়া ব্রিজের পাশে নেয়াজপুর এলাকায় এক ব্যক্তিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।
নারায়ণগঞ্জ : আড়াইহাজারে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বাচ্চু খান (৩৩) নামে এক মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। র্যাব-১-এর উপপরিদর্শক নির্মল জানান, গতকাল ভোর পৌনে ৫টার দিকে ঢাকার কুড়িলসংলগ্ন ৩০০ ফুট সড়কে টহল দেওয়ার সময় একটি নিশান জিপকে থামার নির্দেশ দেয় র্যাব। সেটি না থেমে নারায়ণগঞ্জের ভুলতার দিকে চলে যায়। র্যাবের গাড়ি জিপটিকে ধাওয়া দিলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে আড়াইহাজারের শিমুলতলী এলাকায় জিপ থেকে তিন ব্যক্তি নেমে র্যাব সদস্যদের উদ্দেশ্য করে গুলি ছুড়তে থাকে। র্যাব পাল্টা জবাব দেয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে বাচ্চু খান নামে এক মাদক কারবারির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। তার বাড়ি ঢাকার দক্ষিণখানে। এ ঘটনায় আক্কাস নামে এক র্যাব সদস্য আহত হয়।
আড়াইহাজার থানার ওসি এম এ হক জানান, নিহত বাচ্চু খানের শরীরে সাতটি গুলির চিহ্ন ও বাম পা ভাঙা পাওয়া গেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া : বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মরিচাকান্দি গ্রামের কুখ্যাত মাদক বিক্রেতা ধন মিয়া ওরফে সবুজ (২৫) সোমবার রাতে র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে ১২ হাজার পিস ইয়াবা, একটি বিদেশি পিস্তল, ৬ রাউন্ড গুলি ও প্রাইভেট কার জব্দ করা হয়।
অ্যাডিশনাল এসপি মহিউদ্দিন ফারুকীর নেতৃত্বে র্যাব-১০-এর একটি টিম ইয়াবা ব্যবসায়ী ধন মিয়াকে ধাওয়া করলে প্রাইভেট কারযোগে পালানোর সময় বাঞ্ছারামপুরের সোনারামপুর নামক স্থানে তার গাড়িটির চাকা গর্তে আটকে যায়। এ সময় পেছন থেকে ধাওয়া করা র্যাব-১০-এর গাড়ি লক্ষ্য করে ধন মিয়া গুলি ছোড়ে। র্যাবও পাল্টা গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়। সেখান থেকে তার স্ত্রী আরজিনাকে আটক করা হয়।
দিনাজপুর : বিরামপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রবল হোসেন (৩৫) নামে এক মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। তার বাড়ি উপজেলার দক্ষিণ দামোদরপুর গ্রামে।
পুলিশ জানায়, গতকাল ভোরে বিরামপুর থানা পুলিশ পৌরসভার মনিরামপুর মাঠে টহল দেওয়ার সময় ১০-১২ জন মাদক কারবারি তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় পুলিশের পাল্টা গুলিতে প্রবল হোসেন মারা যায়। এ সময় পুলিশের দুই এসআই আহত হন।
বিরামপুর থানার ওসি আব্দুর সবুর জানান, নিহত প্রবল হোসেন একাধিক মামলার আসামি। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি, পাঁচটি ককটেল ও ৯২ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।
চুয়াডাঙ্গা : আলমডাঙ্গা উপজেলার রেলওয়ে স্টেশন রোড এলাকায় সোমবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাদক কারবারি কামরুজ্জামান সাধু (৫০) নিহত হয়।
থানার এএসআই শফিকুল ইসলাম জানান, উপজেলার হারদী গ্রামের একাধিক মাদক মামলার আসামি কামরুজ্জামান সাধু ও তার কয়েকজন সহযোগী রাতে এক বস্তা ফেনসিডিল নিয়ে স্টেশন এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম পাশে ওৎ পেতে থাকে। এ সময় দুপক্ষে গোলাগুলিতে কামরুজ্জামান নিহত হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি ও এক বস্তা ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। (কালেরকণ্ঠ)
বার্তা কক্ষষ
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur