দেশে ঋণের বোঝা বাড়ছে। আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায় ১ লাখ ৫ হাজার ২৫২ টাকা ঋণের দায় চাপবে। কারণ বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথা পিছু এই পরিমাণ ঋণ রয়েছে। আর গত এক বছরে ঋণ বেড়েছে ৯ হাজার ৬৫২ টাকা।
আগামী এক বছরে আরও ১৫ হাজার ১৮৭ টাকা বাড়বে। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১ লাখ ২০ হাজার ৪৩৯ টাকা। এ কারণে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেখেছে সরকার।
অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের মাথাপিছু বরাদ্দ ৪৪ হাজার ৮৬৩ টাকা। এ হিসাবে ঋণ মাথাপিছু বরাদ্দের প্রায় আড়াই গুণ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর আদায় করতে না পারায় সরকারকে বেশি ঋণের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার প্রতি বছর দেশীয় উৎস থেকে যে হারে ঋণ নিচ্ছে, তা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য ইতিবাচক নয়। এটা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে।
তিনি বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর আদায়ের হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় ৯ শতাংশের কম। অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হলে জিডিপির তুলনায় করের অন্তত ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ থাকা উচিত। তিনি বলেন, করের হার বাড়াতে পারলে ঋণ কমবে। আর উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো ভালো পদক্ষেপ নয়। এতে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট নয়।’
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের আভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ ১৫ লাখ ৫ হাজার ৩৬৩ কোটি এবং সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত মিলিয়ে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। এই ঋণ জিডিপির ৩৪ শতাংশের বেশি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। এ হিসাবে প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ১ লাখ ৫ হাজার ২৫২ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯৫ হাজার ৬০০ টাকা। এ হিসাবে এক বছরে বেড়েছে ৯ হাজার ৬৫২ টাকা।
এদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য আরও ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে। ফলে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি কমপক্ষে আরও ১৫ হাজার ১৮৭ টাকা বাড়বে। এই ঋণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে ঋণ নেওয়া হয়, তার বিপরীতে সরকারকে বছরে ১০ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। এ কারণে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার, যা তিনটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের প্রায় সমান।
এ ব্যাপারে মির্জ্জা আজিজ আরও বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না।
বেসরকারি গবেষনা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসির (সিপিডি) বাজেট বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ঘাটতি মেটাতে অর্থায়নের বড় অংশই দেশীয় ঋণ। এর সুদ অত্যন্ত বেশি। এর ফলে বেসরকারি খাতেও সমস্যা সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে বাজেটে ঋণ নির্ভরতা কমানোর জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। তাই রাজস্ব খাতে বিভিন্ন সংস্কার জরুরি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের মতে, সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে। তুলনামূলকভাবে বিদেশি ঋণ অনেক সাশ্রয়ী। কিন্তু সরকার সহজ পথ হিসাবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। এতে আর্থিক খাতে চাপ বেড়ে যায়।
বর্তমানে দেশে মুদ্রার পরিমাণ ১৭ লাখ ৬৩ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আমানত ১৫ লাখ ৫ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা এবং জনগণের হাতে নগদ টাকা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। আবার আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানত ১৩ লাখ ২৫ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা এবং তলবি আমানত ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা।(যুগান্তর)