চাঁদপুর জেলা শহর থেকে সবচেয়ে কম খরচে দ্রুত ভারত ভ্রমণে চাঁদপুর-লাকসাম-আখাউড়া-আগরতলা রুট এখন বেশ জনপ্রিয়। এ রুটে ট্রেনযোগে আগরতলা যাওয়া-আসার সর্বনিম্ন পরিবহন খরচ মাত্র ৩০০ টাকা। এর মধ্যে যাওয়ার খরচ ১৫০ টাকা। আসার ব্যয়ও সমান।
এছাড়া আগরতলা থেকে কলকাতাসহ ভারতের প্রতিটি প্রদেশে বিমান ভাড়া ঢাকার চেয়ে অর্ধেকেরও কম। এ কারণে আগরতলা বিমানবন্দর হয়ে ভারত ভ্রমণের জন্য আখাউড়া স্থলবন্দরে চাঁদপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার মানুষের ভিড় বাড়ছে।
চিকিৎসা, পারিবারিক পুনর্মিলন, ব্যবসা, কেনাকাটা অথবা ভ্রমণের জন্য চাঁদপুর জেলা থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ভ্রমণের হার অনেক বেড়েছে। আগে চাঁদপুরের অধিকাংশ মানুষ ভারত যাওয়ার ক্ষেত্রে হরিদাসপুর স্থলবন্দর ব্যবহার করতেন অর্থ সাশ্রয়ের জন্য। সে ক্ষেত্রে ঢাকা যেয়ে সেখান থেকে বাসে করে কলকাতা যেতে হতো। প্রয়োজন হলে সেখান থেকে আবার ভারতের অন্য কোনো গন্তব্য। আবার কেউ কেউ সময় ও ঝামেলা কমাতে ঢাকা থেকে বিমানে ভারত যাতায়াত করতেন। তবে তা ছিল ব্যয়বহুল। এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা এবং বিমান ভাড়া কম হওয়ায় অনেকের পছন্দ এখন আখাউড়া-আগরতলা। ফলশ্রুতিতে হরিদাসপুরের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর এখন আখাউড়া।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন অফিসার পিয়ার হোসেন বলেন, আখাউড়া স্থলবন্দর হয়ে ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাইসহ বিভিন্ন প্রদেশগামী যাত্রীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশেষ করে আগরতলা বিমানবন্দর হয়ে অত্যন্ত সুলভ মূল্যের আভ্যন্তরীন (ডোমেস্টিক) বিমান সুবিধা নিতেই এই স্থলবন্দরে ভিড় বাড়ছে। ঈদ ও দুর্গাপূজার সময় অস্বাভাবিকভাবে ভিড় বেড়ে যায়। তখন বাড়তি লোকের চাপ সামাল দিতে যেয়ে কাস্টমস বিভাগ ও ইমিগ্রেশন পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। তবে বাংলাদেশীদের তুলনায় ভারতের নাগরিকরা অনেক কম হারে এ দেশে আসছে। সেই সংখ্যাও দিনে দিনে বাড়ছে।
তিনি আরো জানান, দেশের অন্য স্থলবন্দরগুলোর মতো এই বন্দর হয়ে যাতায়াতের ক্ষেত্রেও প্রাপ্ত বয়স্কদের জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে ট্রাভেল ট্যাক্স দিতে হয়। ভ্রমণ করার সময় অথবা আগে নির্ধারিত ব্যাংক শাখায় এই ট্রাভেল ট্যাক্স দেয়া যায়। তবে আগে দিলে যাওয়ার পথে সময়ের অপচয় কমে যায়।
চাঁদপুর রেলওয়ে বড়স্টেশনে কর্মরত আবদুস সালাম সরকার জানান, চাঁদপুর থেকে আন্তঃনগর ট্রেন মেঘনা এক্সপ্রেসে দ্বিতীয় শ্রেণীর বগিতে লাকসাম যাওয়ার ভাড়া ৫৫ টাকা। নোয়াখালী-সিলেট রুটের উপকূল এক্সেপ্রেসে দ্বিতীয় শ্রেণীর বগিতে লাকসাম থেকে আখাউড়া যাওয়ার ভাড়া ৭৫ টাকা। আখাউড়া রেলস্টেশন থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর যাওয়ার সিএনজি/অটোরিক্সার ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা করে। এ হিসেবে আগরতলা সীমান্তে অর্থাৎ ভারতে পৌঁছা পর্যন্ত জনপ্রতি পরিবহন খরচ পড়ে ১৫০ টাকা। ফেরার খরচও একই অংকের।
অন্যদিকে মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রথম শ্রেণীতে লাকসাম গেলে ভাড়া পড়বে ৯০ টাকা। সে ক্ষেত্রে যাওয়া-আসা মিলিয়ে ভাড়া বাড়বে ৭০ টাকা। অবশ্য লাকসাম থেকে আখাউড়া যাওয়া/আসার জন্য উপকূল ট্রেনে কোনো প্রথম শ্রেণীর টিকেট বরাদ্দ নেই। সে ক্ষেত্রে নোয়াখালী থেকে আখাউড়া অথবা সিলেট থেকে আখাউড়ার টিকেট কাটলে প্রথম শ্রেণীর আসন পাওয়া যাবে। ভাড়া ১৮০ টাকা। তখন জনপ্রতি ভাড়া বাড়বে ২১০ টাকা। তবে প্রতি বুধবার উপকূল চলাচল বন্ধ থাকে।
তিনি আরো জানান, উল্লেখিত দু’টি ট্রেনের সময়সূচির সমন্বয় থাকায় এসব ট্রেনে চড়ে দ্রুত আগরতলা যাওয়া সম্ভব। প্রতিদিন ভোর ৫টায় মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেন চাঁদপুর বড়স্টেশন থেকে ছেড়ে কোর্টস্টেশন হয়ে লাকসামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। সকাল ৭টার মধ্যেই এই ট্রেন লাকসাম যেয়ে পৌঁছে। নোয়াখালী থেকে ছেড়ে আসা উপকূল এক্সপ্রেস লাকসাম পৌঁছে সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে। দশ মিনিটের বিরতি দিয়ে এই ট্রেন আখাউড়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সকাল ৯টার মধ্যে উপকূল এক্সপ্রেস আখাউড়া রেলস্টেশনে পৌঁছে যায়। সেখান থেকে অটোবাইক/সিএনজি অটোরিক্সায় চেপে ৮ কি.মি. দূরত্বের আখাউড়া স্থলবন্দর যেতে সময় লাগে আধা ঘন্টারও কম।
এ রুটে একই ট্রেনে ফেরার ক্ষেত্রেও সময়সূচির সমন্বয় রয়েছে। বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটে আখাউড়া থেকে উপকূল এক্সপ্রেস লাকসামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার মধ্যে ট্রেনটি লাকসামে পৌঁছে। এর ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা মেঘনা এক্সপ্রেস লাকসাম থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রাত ১০টার মধ্যে এই ট্রেন চাঁদপুর শহরে এসে পৌঁছে। ফলে একদিনেও আগরতলা ভ্রমণ করা যায়। সকালের ট্রেনে যেয়ে বিকেলের ট্রেনে ফেরত আসা যায়।
এ রুটের নিয়মিত যাত্রী পুরানবাজারের ব্যবসায়ী রামু সাহা জানান, ভোর ৫টার ট্রেনে রওয়ানা হয়ে সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যেই আখাউড়া সীমান্তে পৌছাঁনো সম্ভব। চাঁদপুর শহর থেকে আখাউড়া সীমান্তে পৌঁছতে সময় লাগে সাড়ে ৪ ঘন্টা। যা চাঁদপুর থেকে ঢাকা বিমানবন্দরে যাওয়ার সময়ের চেয়ে অনেক কম। ট্রেন বলে এখানে যানজটের আশঙ্কাও নেই। ফলে দিনে দিনেই আগরতলা আসা-যাওয়া করা যায়। আবার কেউ কেউ তো উল্লেখিত রুটে ট্রেনে আগরতলা পৌঁছে সেখান থেকে বিমানে কলকাতা যান। কাজ খুব সামান্য হলে দুপুরের পর আবার বিমানে আগরতলা ফিরে বিকেলে আখাউড়া হয়ে রাতে চাঁদপুর পৌঁছে যান। তবে এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি কিছুটা বেশি। এক রাত কলকাতা থাকলেই অনেক কাজ সারা সম্ভব।
উল্লেখিত রুটের আরেক যাত্রী কালিবাড়ি এলাকার ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র কর্মকার বলেন, আখাউড়ার বিকল্প হিসেবে কেউ কেউ কুমিল্লার বুড়ির বাজার স্থলবন্দরও ব্যবহার করে থাকেন। সেক্ষেত্রে বাসযোগে কুমিল্লা যাওয়া-আসাও সহজতর। আবার আখাউড়া যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে কেউ কেউ চাঁদপুর থেকে সিলেটগামী বাস ব্যবহার করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে আখাউড়া উপজেলার দরখাঁ অথবা সুলতানপুর নেমে সেখান থেকে সিএনজি/অটোবাইকে সীমান্ত এলাকায় যেতে হয়। দূরত্ব প্রায় ১৫ কি. মি.। এতে ভাড়া কিছুটা বেড়ে যায়।
চাঁদপুর-সিলেট রুটে চলাচলকারী সততা-একতা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজ সরকার বলেন, চাঁদপুর থেকে বাসযোগে আখাউড়া স্থলবন্দরগামী যাত্রী এখন অনেক বেড়েছে। যাত্রীরা আখাউড়ার দরখাঁ অথবা সুলতানপুরে নেমে যায়। এই পথে জনপ্রতি বাসভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।
আখাউড়া উপজেলা প্রেসক্লাব সভাপতি মহিউদ্দিন মিশু বলেন, একসময় মূলত পণ্য আমদানী-রপ্তানীনির্ভর ছিল আখাউড়া স্থলবন্দর। কিন্তু বর্তমানে এই বন্দর হয়ে যাত্রী পারাপার অনেক বেড়েছে। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা অঞ্চল থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ এখন আখাউড়া হয়ে ভারতের বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করছে। তবে সবচেয়ে বেশি যাত্রী হয় কুমিল্লা অঞ্চলের কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার। বর্তমানে নির্মাণ কাজ চলমান থাকা আখাউড়া-আগরতলা ট্রেন সার্ভিস চালু হলে এই রুটে যাতায়াত আরো সহজতর হবে।
তিনি আরো জানান, যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় আগরতলা সীমান্তে ভারতীয় কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের ব্যাগেজ তল্লাশি, ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ ও কড়াকড়িতে মাঝেমধ্যে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশী পাসপোর্টধারীরা। ভারত থেকে ফেরার পথে বাংলাদেশীদের কাছে সে দেশের কাস্টমস/ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ডলার বিনিময়ের রশিদ (অনুমোদিত মানি এক্সচেঞ্জ থেকে গৃহীত) না পেলে ভোগান্তি ও হয়রানীর শেষ থাকে না।
ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, দুর্গোৎসবের সময় পূজোতে প্রতিদিন আখাউড়া চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে যায় গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার পাসপোর্টধারী যাত্রী। ভারত থেকেও আসে। তবে আসার সংখ্যাটা তুলনামূলক অনেক কম। একইভাবে ঈদের পরবর্তী এক সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার যাত্রী ভারত যায়। এরাই আবার দেশে ফেরার সময় ভিড় বাড়ে।
আখাউড়া ও আগরতলা থেকে ফিরে রহিম বাদশা,
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর প্রবাহ।
৯ নভেম্বর, ২০১৮