রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক প্রাপ্ত চাঁদপুরের প্রথম নারী পুলিশ শামছুন্নাহার সুপার নিজ কার্যালয়ের সামনে অবস্থিত শুক্রবার দুপুরে ( ১৬ মার্চ) পুকুরে হাঁটু সমান কাদা মাটিতে নেমে মাছ শিকার করে এক অন্যরকম চমক সৃষ্টি করলেন।
তিনি তার সহকর্মীদের সাথে মিলে আবহমান বাংলার সাধারণ একজন তরুণীর মত মাছ শিকার করেন। তার মাছ শিকারের সে ছবি এখন ফেইসবুকে ভাইরাল। শত শত মানুষ তার সেই ছবিতে লাইক দিচ্ছে, মন্তব্য করছে, ছবি শেয়ার করছে। বলা চলে বিষয়টি ‘টক অব দ্যা ফেইসবুকে’ পরিণত হয়েছে।
তার এ ছবি ফেইসবুকে প্রথম পোস্ট করেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জি এম শাহীন। এর পর এ ছবি ভাইরাল হতে থাকে। গত কয়েকদিন ধরে প্রায় প্রতিদিনই একাধিকবার এ ছবি শেয়ার হচ্ছে।
এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী পুলিশ সুপার শামছুন্নাহার ১৯৭৩ সালের ১ নভেম্বর ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার চর মাধবিয়া ইউনিয়নের ইসমাঈল মুন্সীর ডাঙ্গিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম শামছুল হক ভোলা মাস্টার। তিনি পেশায় একজন আইনজীবী। অবশ্য কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। এজন্য তিনি ভোলা মাস্টার হিসেবেই এলাকাতে বেশি পরিচিত।
তার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। ফরিদপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিলেন একবার। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। বর্তমানে ফরিদপুর জেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাবা লেখালেখির সাথেও জড়িত। তিনি একজন কবি ও গীতিকার। তার মায়ের নাম আমিনা বেগম। মা একজন স-ুগৃহিনী। আমিনা বেগম রতœগর্ভা মা হিসেবে ২০১৬ সালে আজাদ প্রেডাকশনের সম্মাননা লাভ করেছেন।
২ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে শামছুন্নাহার সবার বড়। তার মেজো ভাই জাপান প্রবাসী চিকিৎসক । সেজো ভাই বাংলাদেশ হাইকোর্টের আইনজীবী এবং ছোট বোন শিক্ষয়িত্রী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত। তার স্বামী মো.হেলালউদ্দিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একজন ব্যবসায়ী। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
শামছুন্নাহার ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ¯œাতোকোত্তর ও এমফিল ডিগ্রি এবং যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছোট বেলায় ইচ্ছে ছিলো আইনজীবী বা পাইলট হবেন। তবে বড় হয়ে ইচ্ছার পরিবর্তন করে মানুষের অধিকতর সেবা প্রদানের লক্ষ্যে পুলিশে চাকুরি করার সিদ্ধান্ত নেন।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণের মাধ্যমে তিনি ২০০১ সালে বাংলাদেশ পুলিশে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন। মানিকগঞ্জ তার প্রথম কর্মস্থল। এরপর তিনি ডিএমপি,পুলিশ হেডকোয়াটার, ট্যুরিস্ট পুলিশে কাজ করেন। তিনি ২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের ইতালিস্থ শাখা অফিসে এবং ২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পূর্ব তৈমুরে জাতিসংঘ মিশনের জাতীয় পুলিশের মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন।
জাতীসংঘের অধীনে চাকুরি করার সময় তিনি সাত বার জাতিসংঘ শান্তিপদক লাভ করেন। ২০১৫ সালের ১২ জুন তিনি চাঁদপুরের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন।
পুলিশে যোগ দেবার পর শামছুন্নাহার এর ইচ্ছে জাগলো তিনি পুলিশ সপ্তাহের জাতীয় প্যারেডে একদিন নেতৃত্ব দেবেন। সে স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে তিনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। ২০০৮ সালে স্বপ্ন পূরণের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন।
ওই বছর জাতীয় পুলিশ প্যারেডে তিনি উপ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। চাঁদপুরে যোগ দেবার পর তার স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়ে যায়। ২০১৬ সালে তিনি পুলিশ সপ্তাহের জাতীয় প্যারেডে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
এর মাধ্যমেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন শামছুন্নাহার। তিনিই প্রথম কোনো নারী পুলিশ কর্মকর্তা যিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে ১৩ টি কনটিজেন্টের প্রায় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সালাম জানান। তাঁর এ পারঙ্গমতার খবর দেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার ও প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তার দিকে নিবন্ধিত হয়।
সাফল্যের এ ধারাবাহিকতায় তিনি পরের বছর ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত পুলিশ সপ্তাহের জাতীয় প্যারেডেও নেতৃত্ব দেন। ওই বছরেই তাঁকে প্রদান করা হয় প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক বা পিপিএম (সেবা)। শামছুন্নাহার ৫ বার আইজি ব্যাজও লাভ করেছেন।
কর্মস্থলে যোগ দেবার পর থেকে শামসুন্নাহার চাঁদপুরের মাদক, বাল্যবিবাহ ও জঙ্গিবিরোধী জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মাদসেবীদের বাড়ি বাড়ি যেয়ে তাদের ভালো পথে ফিরে আসার সুযোগ দিয়েছেন। মাদক, বাল্যবিয়ে ও জঙ্গিবিরোধী সাংস্কৃতিক স্কোয়ার্ড গঠন করে প্রত্যন্ত এলাকায় যেয়ে যেয়ে এসবের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
নিজের কার্যালয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী সেল গঠন করে অসহায় নারী ও শিশুদের বিভিন্ন সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দিচ্ছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে -চাঁদপুর পুলিশ লাইনস্ এ স্থায়ীভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সাত বীর শ্রেষ্ঠদের প্রতিকৃতি স্থাপন।
এছাড়া তিনিই প্রথম জেলার মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের খুঁজে বের করে তাঁদের সম্মাননা দিয়েছেন। শামছুন্নাহার একজন শিল্পীও। তিনি নিজে গান করেন। গান শোনা ও বই পড়া তার শখ। পেশাগত ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি ১২টির মত দেশ ভ্রমণ করেছেন।
চাঁদপুরের অপরাধীদের কাছে শামসুন্নাহার একটি মূর্তিমান আতংকের নাম। প্রত্যন্ত এলাকায় এখন কোনো সমস্যা হলে একজন আরেকজনকে এ বলে ভয় দেখায় এসপি শামসুন্নাহার আসতেছে। জেলার সাধারণ মানুষও তার নাম জানে এবং টেলিফোন নম্বর জানে। তাকে সবাই ফোন করে কথা বলতে পারে। তার সততা, দক্ষতা ও পেশা এবং দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসার বিষয়টি প্রশ্নাতীত থাকলেও তার অজান্তেই তারই অধঃস্থনদের কেউ কেউ তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
বিশেষ করে তার শত চেষ্টা ও আন্তরিকতা সত্ত্বেও চাঁদপুরে মাদকের বিস্তার তো রোধ করাই যাচ্ছে না বরং নানা কৌশলে মাদকের প্রসার বাড়ছে। খোদ চাঁদপুর শহরেই হাত বাড়ালেই ইয়াবা নামের ঘাতক পাওয়া যাচ্ছে। পকেটে পকেটে করে এগুলো বিক্রি হচ্ছে।
চাঁদপুরের এমন হাই প্রোফাইল পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার শুক্রবার (১৬ মার্চ) দুপুরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজের কার্যালয়ের সামনে অবস্থিত পুকুরে মাছ শিকারে নেমে গেলেন। সেচযন্ত্রের মাধ্যমে পুকুরের পানি অপসারণের দৃশ্য বসে বসে দেখছিলেন।
পানি কমে যাবার পর যখন মাছেরা লাফালাফি শুরু করে দিল তখন আর তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না। সেলোয়ার-কামিজ পরা শামছুন্নাহার কোমরে ওড়না গুঁজে নেমে পড়লেন কাদা মাটিতে।
সবার সাথে হৈ চৈ করে মাছ ধরলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক প্যাক-কাদা মিশ্রিত পানি থেকে মাছ তুলে তারপর সেগুলো সহকর্মীদের মধ্যেই ভাগ করে দিলেন। এসময় সেখানে থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্য এসপি শামসুন্নাহারের এমন ব্যতিক্রম কাজের কয়েকটি ছবি মোবাইরে ধারণ করে রাখলেন।
মাছ ধরার বিষয়ে রোববার ও সোমবার কয়েক দফায় এ প্রতিনিধির সাথে কথা হয় পুলিশ সুপার শামসুন্নাহারের। তিনি জানান, তিনি প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। প্যাক-কাদা-পানিতে বড় হয়েছেন। ছোট বেলায় বাড়ির পুকুরে বা গ্রামের জলাশয়ে কত মাছ ধরেছেন। নিজের হাতে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা বলে মন্তব্য করেন।
বহুদিন পর যখন তার কার্যালয়ের পুকুরের পানি সেচে মাছ ধরার ব্যবস্থা করা হয় তখন আর শৈশবের সে আনন্দ পাওয়ার বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে পারলেন না। তাই পুকুরে নেমে মাছ ধরে আনন্দের অংশীদার হলেন। পুলিশ সুপার বলেন,‘হতে পারেন তিনি পুলিশের একজন কর্মকর্তা। তাই বলে তো নিজের ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা অনিচ্ছাগুলো মরে যায়নি।’
তিনি বলেন,‘সবার আগে তিনি একজন মানুষ এবং এ দেশের একজন নাগরিক । দেশের আবহমানকালের যে সংস্কৃতি তা তিনি ধারণ ও লালন করেন। পুলিশের কর্তা হয়েছেন বলে সে সব আদর্শ তো মরে যায়নি।’
তিনি জানান, কে ছবি তুলবে বা কে নিউজ করবে সেটা তার বিবেচনার বিষয় নয়। সম্পুর্ণ ব্যক্তিগত শখ থেকেই এ মাছ শিকার।
লেখক : শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম ,
গণমাধ্যম কর্মী, চাঁদপুর।