বিএনপির রাজপথ আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা মহানগর বিএনপি। সেই মহানগর বিএনপিকে এবার দু’ভাগে বিভক্ত করে নতুন কমিটি ঘোষণা করতে যাচ্ছে দলটি। চূড়ান্ত হওয়ায় আহ্বায়কের পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াচ্ছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এ কারণেই পাল্টে যাচ্ছে নগর বিএনপির রাজনীতির সমীকরণ। এতদিন মনে করা হতো নগর বিএনপির দায়িত্বে যিনি আসবেন, তিনি হবেন আগামী দিনে দলের পক্ষে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রার্থী। কিন্তু সেই হিসেব বাদ দিয়ে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া ইতিমধ্যে সঠিক ও যোগ্য নেতার সন্ধানে যাচাই-বাছাই শুরু করেছেন। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশকয়েকজন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর বিএনপির এক প্রস্তুতি সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘এটাই মির্জা আব্বাসের সভাপতিত্বে নগর বিএনপির শেষ যৌথসভা। যদিও আরো অনেক আগেই এ পদ ছেড়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্তহীনতার জন্য কিছুটা দেরি হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাতে নগর বিএনপির নতুন কমিটির খসড়া তালিকা পৌঁছানো হয়েছে। তিনি খুব শীঘ্রই সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করে নগর বিএনপির নেতৃত্বকে (উত্তর-দক্ষিণ) দু’ভাগে ভাগ করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবেন। সেক্ষেত্রে সংগঠনের নেতৃত্বে গতিশীলতা আনতে এবং সংগঠনের ‘চেইন অব কমান্ড’ ধরে রাখতে প্রথমে ‘সুপার ফাইভ’ কমিটি ঘোষণার নির্দেশনা দিতে পারেন তিনি।
বিএনপির একটি নির্ভরশীল সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর কমিটি গঠনে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি। একাধিকবার কমিটি ঘোষণা করার উদ্যোগ নিয়েও রহস্যজনক কারণে তা শেষ মুহূর্তে এসে আটকে গেছে। দলের অভ্যন্তরে একাধিক বলয় সক্রিয় থাকায় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর ক্ষেত্রে একবার একজনের নাম ঢুকছে, আবার আরেকটি নাম কাটা পড়ছে। তাই ঢাকা মহানগর বিএনপির (উত্তর-দক্ষিণ) এ দু’টি অংশে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে দলের হাইকমান্ড। চলছে নানা হিসাব-নিকাশ। কমিটি ঘোষণার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন হাবিব উন নবী খান সোহেল ও তাবিথ আউয়াল। একদিকে যেমন দলের যুগ্ম মহাসচিব সোহেল নগর বিএনপির একাংশের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে থাকতে চাচ্ছেন না। তেমনি অন্যদিকে নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল নগর কমিটিতে থাকতে চাইলেও রাখতে চাচ্ছেন না চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে সোহেলকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্বে চান তিনি। সেক্ষেত্রে যদি হাবিব উন নবী খান সোহেল ও তাবিথ আউয়ালের বিষয়টি মিমাংসা হয়ে যায় তাহলে নগর (উত্তর) বিএনপির সভাপতি এম এ কাইয়ূম এবং সাধারণ সম্পাদক হবেন অন্য যে কেউ। দক্ষিণের সভাপতি হিসেবে আব্দুস সালামের সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক অন্য যে কেউ নেতৃত্বে চলে আসতে পারেন। কারণ মূলত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার অনুসারীদের নিয়েই ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি ঘোষণা করা হবে। সেক্ষেত্রে কোথাও যদি মির্জা আব্বাসের অনুসারী সভাপতি হয়, তাহলে সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী সাধারণ সম্পাদক আর সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী সভাপতি হলে মির্জা আব্বাসের অনুসারী সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন। এক কথায় ব্যর্থতার তকমা থেকে বের হতে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে দলের এই দু’প্রভাবশালী নেতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই বললেই চলে।
সূত্র জানায়, শেষ পর্যন্ত যদি বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না ঘটে, সেক্ষেত্রে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও অবিভক্ত নগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব আব্দুস সালাম ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) এর সভাপতি আর ঢাকা মহানগর (উত্তর) এর সভাপতি হবেন বিএনপি নেতা ও সাবেক কমিশনার এম এ কাইয়ূম। পাশাপাশি হাবিব উন নবী খান সোহেল ও তাবিথ আউয়াল মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে থাকছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর বিএনপির (উত্তর) কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য এম এ কাইয়ুম, তাবিথ আউয়াল, আহসান উল্লাহ হাসান, আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, মুন্সী বজলুল বসিত আঞ্জু, আব্দুল আলীম নকী, এ জি এম সামসুল হক, শাহিনুর আলম মারফত আলোচনায় রয়েছেন। আর দক্ষিণে সাবেক সদস্য সচিব আব্দুস সালাম, আলহাজ্ব সালাউদ্দিন আহমেদ (দৌড় সালাহউদ্দিন) বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ কাজী আবুল বাশার, নবী উল্লাহ নবী, আব্দুল লতিফ খান, ইউনুস মৃধা, মকবুল হোসেন টিপু, সাব্বির হোসেন আরিফ ও আ ন ম সাইফুল ইসলাম, হাবিবুর রশিদ হাবিব প্রমুখের নাম আলোচনায় রয়েছে। তবে শেষ মুহূর্তে কিছু পরিবর্তন আসলে আসতেও পারে। কারণ বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে ঢাকা মহানগর বিএনপির ভবিষ্যত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘কে বা কারা দলের জন্য কি করতে পারে যেমন অবগত আছি তেমনি নতুন কেউ দায়িত্ব পেলে তারা কি করতে পারবে আর পারবে না তাও কিছুটা জানি ও বুঝি। তারপরও আমি শুধু এতটুকুই বলবো- বিগত আন্দোলন সংগ্রামের পর থেকে এখন পর্যন্ত যারা প্রতিনিয়ত জেল, জুলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়ে শত অত্যাচার নির্যাতনের পরও ঢাকার রাজপথে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে তাদেরকে মূল্যায়ন করা উচিত। বরং কে (খালেদা-তারেক) মা কিংবা ভাইয়ের আস্থাভাজন সে বিবেচনায় না গিয়ে কারা সবচেয়ে বেশি দলের জন্য নিবেদিত সেই বিবেচনা থেকেই নগর বিএনপির কমিটি গঠন করা হউক। অন্যথায় ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি আলোর মুখ দেখবে না। শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়বে।’
তৃণমূল পর্যায়ের একাধিক নেতাকর্মী জানান, ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটি দ্রুত গঠনের অন্তরায় মূলত দলের সিনিয়র নেতাদের মতের অমিল। এর ফলে হাইকমান্ড স্পষ্ট কোনো বার্তা পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, বিপক্ষে নানান যুক্তি দাঁড় করিয়েও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
এদিকে দক্ষিণের কমিটিতে হঠাৎ করে সালাউদ্দিনের (দৌড়) নাম আলোচনায় উঠে আসায় নেতাকর্মীদের মধ্যে কিছুটা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। নেতাকর্মীরা জানান, টাকার বিনিময়ে যদি এই নেতাকে মহানগরের দায়িত্বে আনা হয় তাহলে নগর বিএনপির প্রায় প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড, দলীয় বর্তমান ও সাবেক কাউন্সিলরসহ অনেকেই রাজনীতি থেকে পদত্যাগ করবেন। কারণ ইতোপূর্বে মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানায় ওয়ার্ড বিএনপির কমিটি গঠনের দায়িত্ব পেয়ে দৌড় সালাউদ্দিন ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট দিলকুশায় একটি বৈঠক করে নিজেদের অনুসারীদের এনে পকেট কমিটি করতে চেয়েছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা অফিস ভাঙচুর করে। এছাড়া হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করায় ২০১০ সালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময়১০:০৫ এ.এম, ০৩ এপ্রিল ২০১৭,সোমবার
ইব্রাহীম জুয়েল