মসজিদুল আকসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মসজিদুল আকসা বায়তুল মোকাদ্দাস নামেও পরিচিত। জেরুজালেমে অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কিবলা। মহানবী (সা.)-কে আল্লাহ তাআলা মিরাজের রাতে প্রথমে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান। এরপর ঊর্ধ্ব আকাশ ভ্রমণ করান। মসজিদুল আকসা ও এর আশপাশের এলাকাটি অনেক নবী-রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসুলের সমাধি। মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘জেরুজালেমে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে কোনো নবী সালাত আদায় করেননি বা কোনো ফেরেশতা দাঁড়াননি।’ (তিরমিজি)

মসজিদুল আকসার মোট সাতটি নাম রয়েছে। মসজিদুল আকসা, বায়তুল মোকাদ্দাস, আল-কুদস, মসজিদে ইলিয়া, সালাম, উরুশলেম ও ইয়াবুস। মসজিদুল আকসার নির্মাণ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। একদল ইতিহাসবিদ মনে করেন, মসজিদুল আকসা মূলত হজরত আদম (আ.)-এর হাতে তৈরি হয়, যা পরবর্তী নবীরা পুনর্নির্মাণ ও সংস্কার করেন। আবার অনেকে মনে করেন, হজরত সুলায়মান (আ.) এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তবে সঠিক তথ্য হলো, হজরত ইবরাহিম (আ.) কর্তৃক কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর তাঁর দৌহিত্র হজরত ইয়াকুব (আ.) মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন।

হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত আবু জর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করি, ‘হে আল্লাহর রাসুল, প্রথম কোন মসজিদ নির্মিত হয়েছে?’ তিনি বলেন, ‘মসজিদুল হারাম।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘তারপর মসজিদুল আকসা।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কত বছরের?’ তিনি বললেন, ‘৪০ বছরের।’ (ইবনে মাজাহ)।

হজরত সুলায়মান (আ.) খ্রিষ্টপূর্ব ১০০৪ সালে আল-আকসা মসজিদের পুনর্নির্মাণ করেন। এই মসজিদ নির্মাণে ৩০ হাজার শ্রমিকের সাত বছর সময় লেগেছিল। তিনি খুব সুন্দর নকশায় মসজিদটি নির্মাণ করেন। পরবর্তী বিভিন্ন শাসকের সময় মসজিদে অতিরিক্ত অংশ যোগ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম্বুজ, আঙিনা, মিম্বার, মিহরাব, অভ্যন্তরীণ কাঠামো ইত্যাদি।

৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে সাহাবি হজরত আবু ওবাইদা ইবনুল জাররাহ (রা.)-এর নেতৃত্বে পুরো বায়তুল মোকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের দখলে আসে। এরপর মুসলিম শাসকেরা কয়েকবার এ মসজিদের সংস্কার করেন।

তবে ১০৯৯ সালের ১৫ জুলাই খ্রিষ্টান সেনাপতি গডফ্রে ডিবো ইউনের নেতৃত্বে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর আল-আকসা মসজিদের ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। মসজিদের গম্বুজের ওপরে তারা ক্রুশ স্থাপন করে,­মসজিদের এক অংশকে আস্তাবল বানায় এবং অন্য অংশে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করে।

এভাবে জেরুজালেমে ৪৬২ বছরের মুসলিম শাসনের পতন ঘটে। এরপর দীর্ঘ প্রতীক্ষা, পরাধীনতার শিকল ভেঙে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য মুসলিম জাতি অপেক্ষা করেছিল একজন মুক্তিদূতের। ১১৮৭ সালে হিত্তিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। এ সময়ে আগের নকশা অনুযায়ী আল-আকসা মসজিদের পুনর্নির্মাণ করা হয়।

এরপর খ্রিষ্টশক্তি পিছু হটলেও ইহুদি চক্র বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে লোলুপদৃষ্টি রাখে। তারা ফিলিস্তিন থেকে নিয়ে সুদূর মদিনা পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম এলাকা নিয়ে বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করে বসে। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

১৯৬৭ সালের জুন মাসে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে মিসর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক এ চারটি আরব দেশের প্রতিরোধব্যূহ ধ্বংস করে ইসরায়েল পূর্ব আল কুদস, পশ্চিম তীর, গাজা ও গোলান মালভূমি দখল করে নেয়। বর্তমানে দখলদার ইসরায়েল ঐতিহাসিক আল-আকসা মসজিদ দখল করে রেখেছে। ১৯৬৯ সালে তারা একবার আল-আকসা মসজিদে অগ্নিসংযোগও করেছিল।

বর্তমানে এ মসজিদে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। ইসরায়েলের মুসলিম বাসিন্দা এবং পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসায় প্রবেশ ও নামাজ আদায় করতে পারেন। আবার অনেক সময় বাধাও দেয়া হয়। গাজার অধিবাসীদের জন্য বিধিনিষেধ অনেক বেশি কঠোর।

লেখক: মুহাম্মদ ছফিউল্লাহ হাশেমী , কলেজ শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক ।
২০ অক্টোবর ২০২৩
এজি

Share