চাঁদপুর নদী বিধৌত ঐতিহ্যের জনপদ। পেশাগত কারণে চাঁদপুরের সাথে আমার নাড়ীর টান…। বদলি সূত্রে গত বছরের ১২ নভেম্বর পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে মতলব উত্তর থানায় আমার পোস্টিং হয়।
চাঁদপুর জেলা শহরের দীর্ঘ সময় চাকরি করার সুবাধে অন্যান্য উপজেলার ভৌগলিক কাঠামো ছিলো আমার অপরিচিত। শহর থেকে মতলব উত্তর থানায় যোগদানের জন্য গত গত বছরের ১৩ নভেম্বর সিএনজি যোগে রওনা হলাম, সিএনজিকে বিদায় দিয়ে মতলব ফেরীতে উঠি। কিছুক্ষণের মধ্যে ফেরী এপারে (উত্তর অংশে) পৌঁছে যায়।
ফেরী থেকে নেমে লোকজনদের জিজ্ঞেস করি, মতলব উত্তর থানায় যাওয়ার গাড়ি পাবো কোন দিকে?।
লোকজন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো বাম দিকে যান। কয়েক কদম হেটে যেতে দেখলাম অনেকগুলো সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে ১০/১২টি মোটর সাইকেলে নিয়ে যুবকরা বসে আছে। তারা ‘এই ছেঙ্গাচর, এই ছেঙ্গারচর’ বলে ডাকাডাকি করছে।
একজন এসে বলে স্যার আমার সাইকেলে উঠেন। আমি বললাম তোমার সাইকেলে গেলে সুবিধা কি?। সে বললে রাস্তা খারাপ, আমার মোটর সাইকেলে অল্প সময়ে কম ধাক্কায় যেতে পারবেন’।
যুবকটির কথামতো তার মোটর সাইকেলে উঠে বসলাম। পথ শুরু হলো। চলতে চলতে জিজ্ঞেস করলাম তার নাম। বললো দুলাল হোসেন, বয়স ২৫, বাড়ি মতলন থানাধীন উত্তর ইমামপুর।
বাবা নেই, সংসারের চাকা সচল রাখতে এ কাজে নেমে পড়া।
দুলাল জানায় মতলব উত্তর থানা এলাকায় তার মতো আরো প্রায় ৫০ জন যুবক এভাবে মতলব ফেরীঘাট থেকে ছেঙ্গাচর, ছেঙ্গাচর থেকে কালিপুর বাজার এলাকায় প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভাড়ায় মোটর সাইকেলে যাত্রী পারাপার করে জীবীকা নির্বাহ করে।
সাধারণত সন্ধায় সিএনজি বন্ধ হয়ে গেলে বিপদে একমাত্র বন্ধুর মতো মোটর সাইকেলই থাকে মানুষের উপযোগী যানবাহন। কখনো কারো সুখ কিংবা দুঃখের খবরে, অসুস্থতা অথবা অন্য-জরুরি প্রয়োজনে গ্রামের পথ ধরে মাইলের পর মাইল গরিবে জীবনের সত্যাসত্য এই পথচলা…।
দুলালের সাথে কথায় কথায় একসময় মোটর সাইকেল এসে থামে ছেঙ্গারচর বাজারে।
দেখি এখানেও একটি মোটর সাইকেলের স্ট্যান্ড রয়েছে। এখানেও প্রায় ১৫/ ২০জন যুবক মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়…।
আমাকে নিয়ে আসা মোটর সাইকেল চালক দুলাল হোসেনকে নিজের পরিচয় দিয়ে দেখা করতে বলে কর্মস্থলে চলে আসলাম। ছেলেটি মাঝে মধ্যেই আমার সাথে দেখা করতে আসতো। দেখতে দেখতে প্রায় ৯ মাসের কর্মসময়ে ২০ জুলাই ফরিদগঞ্জ থানায় আমার বদলী হয়ে যায়।
মতলব থেকে চাঁদপুর শহরে এই ৯ মাস আসা যাওয়ার পথে ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেলই ছিলো আমার এক মাত্র যানবাহন। আসা যাওয়ার পথে মোটর সাইকেল চালকদের সাথে তাদের জীবন সংগ্রামের গল্প শুনতাম। তাদের নিয়ে অনেক সময় ভাবতাম।
অনেকেই আমার বদলীর কথা শুনে অশ্রুসজল হয়েছিলো। অথচ তাদের জন্য আমার করার কিছুই নেই। আছে শুধু ভাবনা…।
ভাবনায় যে বিষয়টি আমাকে তাড়িত করে তা হলো, শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এ যুবকরা চাকরির অভাবে এ পেশা বেছে নিয়েছে। প্রতিদিন তারা হালাল রুজি করে পরিবার-পরিজন চালাচ্ছে।
যেখানে মাদক আর জুয়ার মতো নেশা দেশের বর্তমান সামাজকে কুড়ে কুড়ে খায়, সেখানে অর্ধশত যুবকের জীবন যুদ্ধের এ গল্প আমাকে আশান্বিত করেছে…।
সুযোগ সীমাবদ্ধতার পাশ কেটে ওঠা আপন আত্মশক্তির এ সক্ষমতা মতলব জনপদের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এমন কর্মযজ্ঞে মেতে উঠা সাহসী যুবকদের অন্তরিক অভিবাদন…।
লেখক পরিচিতি, মাহবুবুর রহমান মোল্লা, ওসি (তদন্ত), বিশেষ শাখা, চাঁদপুর জেলা পুলিশ।