ফাইল ছবি
প্রতি বছরের ন্যায়ে আজ শুক্রবার (৩১মার্চ) ১৭চৈত্র থেকে পরবর্তী ৭দিনব্যাপি থেকে শুরু হয়েছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার সাদুল্যাপুর ইউনিয়নের বদরপুরের বেলতলীতে সপ্তাহব্যাপি সোলেমান লেংটার মেলা।
ল্যাংটার মেলায় এসে সোলেমান শাহ ল্যাংটার অনুকরণ করছে তার ভক্তরা। আজ শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ মেলা চলবে।
এবার পালিত হচ্ছে শাহ্ সোলেমান লেংটার ৯৮তম ওরশ শরীফ। শাহ্ সোলেমান লেংটার ওফাত দিবস উপলক্ষে গত ৯৭ টি বছর যাবত উদযাপিত হয়ে আসছে সাত দিনব্যাপি মেলা।
স্থানীয়দের মতে বেলতলীর বদরপুর গ্রামে সোলেমান শাহ নামে এক ফকিরের মাজার আছে। এই মাজারই ল্যাংটা ফকিরের মাজার হিসেবে পরিচিত।
কথিত আছে, সোলেমান শাহ জীবদ্দশায় একটুকরো কাপড় দিয়ে লজ্জাস্থান ডেকে রাখতেন বলে তাকে লেংটা পাগল ডাকতো সবাই। প্রতি বছর এ অসংখ্য বক্তরাই লেংটার মেলার আয়োজন করে।
প্রতি বছর ৩১ মার্চ শুরু হয় এ মেলা, শেষ হয় ৬ই এপ্রিল। সোলেমানের জন্মস্থান কুমিল্লা জেলার বর্তমান মেঘনা থানার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে। তার জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মতলবের বদরপুরের এ বেলতলীর তার বোনের বাড়িতে।
ল্যাংটার মাজার
সেখানে থেকে নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলী গ্রামে তিনি বিয়ে করেন। অনেকেই দাবি করেন তার বংশধর এখনও আছে। সোলেমান শাহ কাউকে মুরিদ করেননি। তবে মতলব তথা দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি ও অগণিত ভক্ত। প্রতিবছর অগণিত ভক্ত এ ল্যাংটা মেলার আয়োজন করে থাকে।
বাংলা ১৩২৫ সালের ১৭ চৈত্র সোলেমান শাহ বেলতর্লী বদরপুর তার বোনের বাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৮ চৈত্র তাকে বদপুরের এই বেলতলীতে (যেখানে মাজার) দাফন করা হয় বলে মাজার পরিচালনায় দায়িত্বে থাকা খাদেম মোঃ দেলোয়ার হোসেন মোল্লা জানান।
তারপর ভক্তরা তার বোনের বাড়িতে মাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় সপ্তাহব্যাপি লেংটা পাগলের মেলা। যদিও তার মৃত্যু তারিখের দু’একদিন আগে পড়ে এখানেই ৭ দিনব্যাপি ওরশ হতো।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লঞ্চ, ট্রলার, বাস, মিনি বাস, ট্রাক, মেক্সী, প্রাইভেটকার যোগে ওরশে আসে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ। তাঁরা নিয়ে আসেন গরু, মহিষ, ছাগল, মোরগ, ডিম, ডাল, চাউল, নগদ অর্থসহ বিভিন্ন মানতি জিনিসপত্র।
ল্যাংটার মেলায় একদিকে আনন্দের হিল্লোল অন্যদিকে বসে গাঁজার রমরমা আসর। অনুসন্ধানী চোখে তাকালেই দেখা যায়, দলে দলে ভাগ হয়ে গাঁজা টানছে পাগলের ক্ষুদ ক্ষদ্র্র দল। তবে এ ব্যাপারে প্রশাসন নিরব ভুমিকা পালন করে। বৃহস্পতিবার (৩০ মার্চ) থেকেই ল্যাংটার ভক্ত আশেকানরা আস্তানা নিয়ে বসে গেছে।
আর এই মেলাকে ঘিরে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা পকেটমার, ছিনতাই, মলমপার্টি, হিজড়া, প্রতারকদের তৎপরতা বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্তরা লেংটা বাবার দরবারে পূন্য, রোগমুক্তিসহ বিভিন্ন কামনা-বাসনা নিয়ে আসেন।
এছাড়াও ঢোল-কারার মাধ্যমে বাবার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় গান ও মজমা বসায় পূন্যের আশায়। মাজার কমিটি প্রতিবছর ভাল অংকের টাকাও উপার্জন করে থাকে। আর এ মাজারে দেওয়া মানতি টাকা কতিপয় কয়েকজনের পকেটে।
এ টাকা নিয়ে চলে মারামারি। দোকান বসে প্রায় ৫ সহস্রাধিক। মেলা চলাকালীন ছোট দোকানে ভাড়া দিচ্ছে ১ সপ্তাহের জন্য ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। মিষ্টির দোকান ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, খেলনার দোকান ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এমনিভাবে অসংখ্য টাকা উঠছে মেলা উপলক্ষ্যে।
আর মেলাতে যদি পুতুল নাচ ও সার্কাস বসানো হয়, তাহলে মানুষের সমাগম হয় প্রচুর।
এদিকে সপ্তাহ ব্যাপী শাহ সোলেমান শাহ লেংটার মেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একটি মেডিকেল টিমও মোতায়েন করা হয়েছে।
এছাড়া অসংখ্য ভক্ত রয়েছেন তারা ল্যাংটা বাবার মাজার জেয়ারত করছেন এবং জিকির আজকার করে ঢোল বাদ্য,বাজনা বাজিয়ে মাজার ত্যাগ করছেন।
কারণ তাদের মতে, ল্যাংটা ফকির ছিলেন একজন ভালো লোক। মেলাকে ঘিরে বৃহস্পতিবার থেকেই অসংখ্য পাগল ও ভক্তবৃন্দদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠেছে মতলবের বেলতলী।
বৃহস্পতিবার মেলার চতুরদিকে ঘুরে এসব চিত্র দেখা যাচ্ছে। মাজারের পবিত্রতা রক্ষার্থে প্রশাসনের কড়া নজরদারি রয়েছে বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন মজুমদার জানিয়েছেন।
লেংটার মেলায় প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভীড় ও দূর-দুরান্ত থেকে আসা অসংখ্য লোকের তত্ত্বাবধান করতে সমস্যা হয় কি না প্রসংঙ্গে মেলার প্রধান তত্ত্বাবধানকারী সাদুল্যাপুর ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও মোঃ দেলোয়ার হোসেন চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও দীর্ঘ্যদিনের অভ্যাসের কারণে এখন আর কোন সমস্যা মনে করিনা। তাছাড়া স্থানীয় লোকজন একাজে অনেক সহযোগিতা করে থাকেন।
মতলব উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আলমগীর হোসেন মজুমদার চাঁদপুর টাইমসকে জানান, মেলা চলাকালীন সময়ে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি যাতে সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক থাকে তার জন্য এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ উপলক্ষে গোয়েন্দা, ডিবি, এসবি, প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
পুলিশের এ কর্মকর্তা আরো জানান, ‘মেলার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, আনছার ও কমিউনিটি এবং বিশেষ পরিস্থিতির জন্য রিজার্ভসহ প্রায় দু’শতাধিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ওরশের পবিত্রতা রক্ষা ও নির্ভিঘেœ ওরশ পালন করার স্বার্থে কোন প্রকার মাদক বিক্রি করতে দেয়া হবে না। এর সাথে কারো জড়িত পাওয়া গেলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এদিকে বৃহস্পতিবার মতলব উত্তর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনজুর আহমদ মঞ্জু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম, মতলব উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আলমগীর হোসেন মজুমদার ল্যাংটার মাজার এলাকা ও মেলা পরিদর্শন করেছেন এবং মাজার কমিটি ও স্থানীয় গণ্যমান্যদের সাথে বৈঠক করেছেন।
প্রতিবেদক- খান মোহাম্মদ কামাল
আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৩: ০০ পিএম, ৩১ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার
ডিএইচ
