মতলব উত্তর

মতলবে খেজুরের রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা

চাঁদপুরের মতলব উত্তরে এবার শীত বিলম্বে এলেও জমিনে রোদ্দুরের গায়ে আধো আধো সোনালি রঙ ধরেছে। বিগত বছরগুলিতে এ মৌসুমে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করতেন গাছিরা।

শীতের আগমনে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার প্রতিটি এলাকা জুড়ে এখন ঐতিহ্যবাহী মধুবৃক্ষ খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরীতে ব্যস্ত গাছিরা। দেরিতে হলেও ভোরের ঘুম ভাঙা সকাল এখন কুয়াশায় মাখামাখি। খেজুরের গাছগুলিতে হাঁড়ি ঝুলানো শুরু করেছেন গাছিরা।

অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠা খেজুর গাছের কদর এখন অনেক বেশি। প্রতিদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির আঙ্গিনা, রাস্তার ধারে ও মাঠের খেজুর গাছ গুলি থেকে রস সংগ্রহরে জন্য হাড়ি পাতছেন গাছিরা আর শীত উপেক্ষা করে প্রতিদিন ভোর থেকে মধুবৃক্ষ খেজুরের গাছে গাছে উঠে রস সংগ্রহ করেন গাছিরা। বাড়িতে পরিবারের সদস্যরা সেই রস জ্বাল দিয়ে তৈরী করছেন সুস্বাদু খেজুরের পাটালি ও ঝোলা গুড়।

যদিও তারা বলছেন, শীত বেশি পড়ছে না বলে রসও হাঁড়িতে খুব একটা উঠছে না। আর রসের হাঁড়ি না ভরা পর্যন্ত চলছে তাদের অপেক্ষার পালা। ইটভাটায় জ্বালানির দাপটে খেজুর গাছ কেটে অনেকটাই সাবাড় হয়ে গেলেও যা আছে এ অঞ্চলের মানুষকে তা খুশি করার পক্ষে কম নয়।

শুক্রবার বিকেল ২টার সময় উপজেলার ছেংগারচর বাজার টিএন্ডটি অফিস সংলগ্ন উপজেলা পরিষদ সড়কের খান ভিলা (সাংবাদিক বাড়ি) এলাকায় গিয়ে দেখা যায় গোলাম হোসেন মামুন (৪৫) নামের মাঝ বয়সী এক ব্যাক্তি একটি খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে হাড়ি পাতছেন। শতব্যস্ত দেখেও কথা বলতে চাইলে বলেন, আমি আমার বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য দীর্ঘ ৩৪ বছর যাবত ঐতিহ্যবাহী মধুবৃক্ষ খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরীতে এখনও এ পেশায় আছি।

আগে শীত আসলেই মতলবের প্রায় প্রতিটি পরিবারের দেখা যেতে খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরী হচ্ছে। নতুন খেজুরের গুড় আর নতুন ধানের চাল দিয়ে শুরু হতো নবান্নের উৎসব। তাছাড়াও শীতের সকালে সুমৃষ্ট খেজুরের রস কেনা পছন্ধ করে।

উপজেলার ছেংগারচর পৌরসভার দেওয়ানজি কান্দি গ্রামের গাছি গোলাম হোসেন মামুন আরও জানান, নভেম্বরের এই সময়ের মধ্যে গাছিরা একেক জন অন্তত দেড়শ থেকে দুইশ খেজুর গাছ কেটে ফেলতেন। অথচ, এ বছর ১৫-২০টির বেশি গাছ কাটতে পারেননি।

তিনি জানান, একটা খেজুর গাছ তিনবার কাটার পরে তাতে নলি লাগিয়ে রসের জন্য ভাঁড় পাতা হয়। একটা খেজুর গাছ থেকে দিনে দু’বার রস মেলে। তিনি গত বছর ৬০টির মতো খেজুর গাছে রস সংগ্র করেছেন। তিনি তার বাড়িতে ৩১ টি খেজুর গাছ লাগিয়েছেন রস সংগ্রহের জন্য। যা তিনি ইতিমধ্যে রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তÍুত করে ফেলেছেন। শীত মৌসুমে খেজুরের গাছের রস বাজারে বিক্রয়ের টাকা দিয়েই কোনমতে আমাদের সংসার চলে।’

ভোরের রসকে মিষ্টি এবং বিকালের রসকে তারি বলে। মাঘ মাস থেকে রস কমতে শুরু করে। ওই সময়ে রসের ঘনত্ব বাড়ে। এ উপজেলায় হাজার খানেক খেজুর গাছ রয়েছে বলে গাছিরা জানিয়েছেন।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, এখনও বহু গাছ ঝাড়া হয়নি। স্থানীয়রা জানান, অতীতে বহু খেজুর গাছ ছিল। ইটভাটায় জ্বালনি হিসাবে অনেক গাছ বিক্রি করা হয়েছে। রস মৌসুমে প্রতিটি খেজুর গাছ বিক্রি হয় ২/৩শ’ টাকায়। গাছ বাইরে থেকে কাঠ ব্যবসায়ীরা গ্রামে এসে গাছ কিনে নিয়ে যান। মূলত ইট ভাটার জ্বালানির জন্য খেজুর গাছের চাহিদা রয়েছে। যদিও দাম অন্য গাছের তুলনায় কম।

খেজুর গাছের মালিকরা জানান, এখনও শীত না পড়ায় রস তেমন ভাবে হচ্ছে না। মৌসুমে একটি খেজুর গাছ থেকে ২০-২৫ কেজি রস পাওয়া যায়। সপ্তাহে একদিন গাছ কাটা হলে তিন দিন রস পাওয়া যায়। কিন্তু এ বার একদিনের বেশি রস হচ্ছে না। পরিমাণেও তা ৫ কেজির বেশি নয়। শীত না পড়ায় রসে স্বাদ আসেনি। শীতের সকালে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে খেজুর রস খাওয়ার মজাই আলাদা বলে জানিয়েছেন সাধারন মানুষ।

তবে কোনপ্রকার সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এবং খেজুর গুড়ের নামে ভেজাল গুড় তৈরী হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য। আর এই সুযোগকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কাজে লাগিয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় তৈরী করছে ভেজাল খেজুরের গুড়। তবে ভেজাল প্রতিরোধ ও গুড় শিল্প রক্ষায় সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে খেজুরের গুড় পুনরায় ফিরে পাবে তার ঐতিহ্য এমনটিই মনে করেন এলাকাবাসী।’

প্রতিবেদক:খান মোহাম্মদ কামাল

Share