চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তরের নিভৃতপল্লীর হাছিনা বেগম গ্রামীণ ব্যাংকের একজন পরিচালক মন্ডলীর সদস্য। সারাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক (Board of Director) মন্ডলীর ১৩ সদস্যের মধ্যে তিনি একজন । জীবনের অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে হাছিনা বেগমকে এ পদে আসতে হয়েছে। তিনি কেবলমাত্র মতলববাসীর গৌরবের ব্যক্তিত্ব নন ; তিনি চাঁদপুরেরও। কেননা-সারাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের একজন পরিচালক মন্ডলীর সদস্য হওয়া চাঁদপুরের ইতিহাসে এটাই প্রথম।
পার্থিব জগতের অনেক নর-নারীই নিজেদের প্রয়োজনে এবং মহান সৃষ্টিকর্তার তাগাদাকে সম্মান দেখিয়ে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবার,সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের কল্যাণে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। যিনি আন্তরিকতা,কঠোর পরিশ্রম, সততা, ধৈর্য্য ও নৈতিকতার মাধ্যমে এগিয়ে গিয়েছেন তিনিই শত প্রতিকুলতাকে পাশ কাটিয়ে সফলতার দ্বার প্রান্তে দাঁড়াতে সক্ষম হয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রে তথা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছেন। ইতিহাস কিংবা অতীত অভিজ্ঞতার দিকে তাকালে হাজারও সংগ্রামী শ্রমজীবী সার্থক নর-নারীর নাম ইতিহাসের পাতায় ভেসে উঠে। সমাজ-সংসারে চাঁদপুরের মতলববাসীর এমনই একজন প্রতিষ্ঠিত সংগ্রামী নারীর নাম হাছিনা বেগম।
চাঁদপুর জেলায় মতলবের দশানী গ্রামে হাছিনা বেগম ১০ আগস্ট ১৯৮২ সালে প্রমত্তা মেঘনা নদীর শাখা মেঘনা ধনাগোদা নদীরতীরে এক মুসলীম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যাঁর পরিবারটি নদীর কল কল শব্দ দিবসের ২৪ ঘন্টাই শুনতে পেত। তাঁর পিতার নাম আবদুল আজিজ সরদার এবং মাতার নাম জাহানারা বেগম। তাঁর মাতা-পিতার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম সন্তান। পিতা ছিলেন একজন ভূমিহীন কৃষক।
২০০৬ সালে মতলব উত্তরের নিচিন্তপুর গ্রামের মো.মাসুদ শিকদারের সাথে ১০ম শ্রেণিতে অধ্যয়ন কালে তাঁর বিয়ে হয়। হাছিনা বেগমের স্বামীর সহায় সম্বল কিছু ছিল না বললেই চলে। জীবন গড়ার প্রারম্ভে অন্যের মনোহরী দোকানে ব্যবসা করতেন এবং তাঁর একখানা দো-চালা ঘরে জীবন যাপন করতেন হাসিনার পরিবারটি। হিমেল হোসাইন ও আয়শা আক্তার মাহি নামে তাঁর দু’ সন্তান রয়েছে।
দাম্পত্যজীবনের শুরু থেকেই তিনি তাঁর স্বামীর সামান্য আয় থেকে বাড়ির পাশের একটা পতিত জমিতে মুরগীর ফার্ম দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন এবং একটি গাভী লালন-পালন করেন। এ ভাবেই শুরু হলো -হাছিনা বেগমের বেঁচে থাকার সংগ্রামী জীবন।
অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার মধ্যে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসের কোনো একদিনে নিচিন্তপুর বাজারে গ্রামীণ ব্যাংক দুর্গাপুর মতলব শাখার তৎকালীন ওপেনিং শাখা ব্যবস্থাপক মো.শহিদুল ইসলামের সাথে দেখা করে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কিত নিয়ম কানুন জেনে কেন্দ্র খুলতে আগ্রহী হন এবং তিনি তাঁর নিজের উদ্যোগেই দুর্গাপুর মতলব শাখার প্রথম কেন্দ্র গঠন করেন। ঋণী হিসেবে ৬ নভেম্বর ২০০৭ সদস্য পদ গ্রহণ করেন।
হাছিনা বেগম সদস্য পদ গ্রহণ করে প্রথম দফায় ৫ হাজার টাকা সহজ ঋণ গ্রহণ করে ঔ মুরগীর ফার্ম পরিচালনা করা শুরু করেন। গ্রামের মহিলা হিসেবে হাছিনা বেগমের ইচ্ছাশক্তি শত প্রতিকুলতাও তাঁকে সম্মুখ্য চলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে নি। তিনি ২০০৭ সাল থেকেই দফায় দফায় গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিচিন্তপুর বাজারের স্কুল ও কলেজের ক্যাম্পাসের পাশে ছোট একটা দোকানে কসমেটিকসহ অন্যান্য প্রসাধনীর ব্যবসা পরিচালনা করেন।
যা ছিল যুগপোযোগী একটি চমকপ্রদ ও লাভজনক ব্যবসা। এরই মধ্যে তিনি স্বামী মাসুদ শিকদারকে বিদেশ পাঠিয়ে দেন। বিদেশ থেকে আসার পর কসমেটিকসহ অন্যান্য প্রসাধনীর চাহিদা বাড়ার কারণে স্বামীকে দিয়ে ঢাকার পাইকারী বাজার থেকে কসমেটিকসসহ অন্যান্য প্রসাধনী মালামল আনতে শুরু করেন।
দোকানের আয় দিয়ে এইচ. এস. সি পাশ করা ছেলেকে ২০২২ সালের প্রথমার্ধে সৌদি আরব পাঠিয়েছেন। সৌদি আরবে ভালো কাজও পেয়েছে হিমেল । মেয়ে আয়শা আক্তার মাহি এখন নিচিন্তপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ শ্রেণিতে অধ্যায়ন করেন।
গ্রামীণ ব্যাংক দুর্গাপুর মতলব শাখাটি ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই অদ্যাবধি কোনো ধরণের অনিয়ম তিনি করেন নি কিংবা লোকসানের কবলে পরে নি। তিনি তাঁর অনন্য ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৯ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের দেয়া ‘ রাজা ব্্োদওয়াঁ ’ পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর চাল-চলন, আচার-আচরণ,কথা-বার্তা, নি: স্বার্থ কেন্দ্র পরিচালনার দক্ষতায়, শাখা তথা ব্যাংকের প্রতি ভালবাসার প্রতিদান স্বরূপ ও তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সদস্যগণ তাঁকে ব্যাংকের নীতিমালা মোতাবেক পর্যায়ক্রমে ৭ বার কেন্দ্র প্রধান নির্বাচিত করেন।
সৎ গুণাবলীর কারণে এবং কেন্দ্রের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে ধাপে ধাপে এগিয়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক এর ২০২১ সালের শাখা স্তরে ২৯ আগস্ট ২০২১ নির্বাচনে শাখা প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি অঞ্চল স্তরের ৯ অক্টোবর ২০২১ নির্বাচনে শাখা ও নিজ গুণাবলীতে অঞ্চলের অন্যান্য শাখা প্রতিনিধিগণের সম্মতিক্রমে অঞ্চল প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। এরপর এলাকা স্তরের মূল্যায়নে ২০ অক্টোবর ২০২১ নির্বাচনে তিনি তাঁর অনন্য পারফরমেন্স এবং স্বীয় নেতৃত্বের পরিচয়ে‘গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক মন্ডলীর সদস্য’ (Board of Director) পদ লাভ করেন।
২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মতে- সারাদেশে ৮১ হাজার ৬শ ৭৮ টি গ্রামের ভেতর গ্রামীণ ব্যাংকের ২ হাজার ৫শ ৬৮ টি শাখায় কেন্দ্র সংখ্যা- ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫শ ৭৮টি এবং সদস্য সংখ্যা ৯৯ লাখ ৩০ হাজার ৬শ ১৪ জন।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিমাসে বোর্ড সভায় যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন তিনি। সর্বপ্রথম তিনি ৭ অক্টোবর ২০২১ প্রথম সভায় অংশগ্রহণ করেন। এ পর্যš সব বোর্ড সভায় তিনি যোগদান করেন বলে জানান। চাঁদপুরে গ্রামীণ ব্যাংকের ৬টি এরিয়া অফিস ও ৫৪ টি শাখায় ১ লাখ ৮৩ হাজার সদস্য রয়েছে। তিনিও এরমধ্যে একজন।
হাছিনা বেগম বলেন ,‘ প্রকৃতপক্ষেই আমি একজন সংগ্রামী নারী। আমার ইচ্ছাশক্তি,পরিশ্রম, সততা, আন্তরিকতা ও ধৈর্য্্যকে কাজে লাগিয়ে জীবন যুদ্ধে আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিবারকে স্বচ্ছল করেছি। তাই গ্রামীণ ব্যাংকেও আমি সমাদৃত হয়েছি।’
গ্রামীণ ব্যাংক, যোনাল ম্যানেজার এস এম সোয়েব বলেন, ‘ গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার বিষয়টি বিরল উদাহরণ ও গ্রামীণ ব্যাংকের পদ-পদবি’র উচ্চ সম্মানীয় স্থান। এ ব্যাংকিং সেক্টেরে অনেক কর্মকর্তা দেশের বড় বড় বিশ^বিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করার পর গ্রামীণ ব্যাংকে প্রবেশ করে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
গ্রামীণ ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় যে কেহ লবিং বা ওয়েলিং কিংবা অন্যকোনো প্রবেশ পথে ঢুকে ঔ পদ অলংকৃত করার কোনোই সুযোগ নেই। গ্রামীণ ব্যাংক পরিবারে মিসেস হাছিনা বেগমের ন্যায় অনেক মহিয়সী সংগ্রামী নারী সদস্য তাঁদের প্রতিচ্ছবি দর্পণের ফ্রেমে স্থান করে নিয়েছেন। অবশ্যই পরবর্তী প্রজন্ম ও ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ শ্রদ্ধার সাথে তাঁর আদ্যপান্ত এ ভূমিকার কথা স্মরণ করবে। ’
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সৃষ্টিশীল সাম্যবাদী কবিতায় লিখেছেন-‘‘বিশ্বে যা-কিছু মহান-সৃষ্টি চির কল্যাণকর,অর্ধেক তার আনিয়াছে নারী,অর্ধেক নর।’’ চাঁদপুরের মতলব উত্তরে হাসিনা বেগম একজন সেই মহিয়সী নারী যিনি তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন অন্তকাল ।
তথ্য ও সাক্ষৎকার প্রদান :এস এম সোয়েব,যোনাল ম্যানেজার, গ্রামীণ ব্যাংক, চাঁদপুর যোনাল অফিস, ট্রাক রোড, চাঁদপুর।
আবদুল গনি
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
এজি