বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোট ছাড়াও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়া অন্য দলগুলো আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনের কথা আর ভাবছে না। বরং দলগুলোর কার্যক্রম এখন পুরোদমে নির্বাচনমুখী। পাঁচ জানুয়ারির ভোটের সময় ‘নিরপেক্ষ’ সরকারব্যবস্থার পক্ষে স্বতন্ত্র অবস্থানে থাকা এসব দলের এবার কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পাশাপাশি নির্বাচন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও বাহিনীগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও নিরপেক্ষ ভূমিকার উপরই মনোযোগ দেওয়ার পক্ষে নীতিগত অবস্থান নিয়েছে এসব দল।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে দলগুলো জোটবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে। অবশ্য এই প্রক্রিয়া একটু এগিয়ে আবার পিছিয়েও যাচ্ছে। ডান-বাম প্রশ্নের পাশাপাশি বিভিন্ন ইস্যুতে দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে মতের বিস্তর ফারাক। সর্বশেষ গত ১৩ জুলাই দলগুলোর বেশিরভাগ নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসায় বসলেও মতের মিল না হওয়ায় এ প্রক্রিয়া আবার পিছিয়ে পড়ে। তবে আগামীতে ‘অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের পক্ষে নেতারা একমত হয়েছেন।
রবের বাসায় বৈঠকে অংশ নেওয়া কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা, আওয়ামী লীগ না বিএনপির পক্ষে, এখনই রাস্তার আন্দোলনে নামবে নাকি পরিস্থিতি আরও পর্যবেক্ষণ করা হবে-এ রকম নানা ইস্যুতে তারা ভিন্ন ভিন্ন মত দেন।
বৈঠকে একজন বলেছেন, ‘ধরে নিলাম আমরা জোট বেঁধে আন্দোলন করলাম, নির্বাচনও হলো, ফল হলো আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি ক্ষমতায় এলো, এতে আমাদের কী লাভ! বরং লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি।’
আরেক নেতা ওই বৈঠকে বলেছেন, ‘আমার কাছে যতটুকু খবরাখবর আছে তাতে দেখা যাচ্ছে এ বছরের অক্টোবর নাগাদ অনেক কিছু পরিষ্কার হওয়া যাবে, সুতরাং আমার মতে অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর আমরা আবার বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’
একটি ডানপন্থি দলের একজন নেতা বলেছেন, ‘বিএনপির পথ ধরে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে আমরা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। বিএনপির জন্য আমরা কেন ক্ষতিগ্রস্ত হবো! সুতরাং আগামীতে আমাদের উচিত হবে ভোটে যাওয়া, এক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে নির্বাচনকে যতটুকু সম্ভব গ্রহণযোগ্য করার পক্ষে আমরা কাজ করতে পারি।’ জানা গেছে, রবের বাসায় যাওয়া নেতাদের বেশিরভাগই এই সর্বশেষ মতকেই সমর্থন করেছেন।
জোট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও রবের বাসায় বৈঠকে উপস্থিত থাকা নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বিভিন্ন ইস্যুতে জোট গঠনের বিষয়টি কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। কেউ বলছেন- আমরা জোট না করে এখন গণতন্ত্রের জন্য কিছু কর্মসূচি নিয়ে এগোতে পারি। এক দল কর্মসূচি দিলে সেখানে অন্যরাও উপস্থিত থাকতে পারি, এভাবে আপাতত কাজ করতে থাকি। কেউ বলেছেন-বিএনপিকে ক্ষমতায় এনে আমাদের লাভ কি? তখন আমি বলেছি- ফ্রান্স বা ভারতের মতো হয়তো নির্বাচন আমরা করতে পারবো না, কিন্তু অন্তত সম্প্রতি ব্রিটেনের নির্বাচনের মতো করতে পারলেও হবে—তাতে অন্তত একতরফা সংসদ হবে না, এটাও তো কম অগ্রগতি হবে না। পরে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে সবাই যেটাতে একমত হয়েছেন সেটা হলো- নির্বাচনটা যেন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হয়, সেজন্য আমরা কাজ করে যাব।’
উল্লেখ্য, বিএনপিসহ ২০ দল ছাড়াও ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (খালেকুজ্জামান)সহ আরও বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলও পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি।
রবের বাসায় যাওয়া নেতাদের ছাড়াও আরো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচ জানুয়ারির ভোট বর্জনকারী এই দলগুলো এখন নিজেদের কথা ও নিজ দলের রাজনীতির ভবিষ্যত্ ভাবছেন।
সূত্রমতে, ১৩ জুলাই উত্তরায় ওই বৈঠকে পুলিশি বাধার পর আ স ম রবকে টেলিফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এছাড়া বিএনপির বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগ দিলেও এবার রজমানে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গণভবনে ইফতারে গেছেন অধ্যাপক বি. চৌধুরী। ইফতার শেষে বি. চৌধুরীর সঙ্গেও ওবায়দুল কাদের আগামী নির্বাচন নিয়ে আলাপ করেছেন। সূত্রের দাবি, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জোটের বাইরে থাকা উল্লেখযোগ্য এই দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের কারো কারো সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ রয়েছে। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সঙ্গেও দলগুলোর ইতোমধ্যে কথাবার্তা হয়েছে। গণফোরাম, সিপিবি, বাসদ, জেএসডি, বিকল্পধারা ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেও যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো— সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ দেখলে তারা নির্বাচনে যাবেন।
পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান ছিল ড. কামাল হোসেনের। তবে এখন তিনি বলছেন, বিদ্যমান সংবিধানেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। তার মতে, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে হবে। সঙ্গে দরকার দলনিরপেক্ষ জনপ্রশাসন।
বিএনপির জোটে না থাকলেও দলটির সঙ্গে অভিন্নকণ্ঠে এতদিন নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তবে বর্তমানে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। আ স ম আবদুর রব বলেন, ‘নির্বাচন যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় তাহলে অবশ্যই আমরা তাতে অংশ নেব। এ ব্যাপারে আমাদের পার্টির অবস্থান পজিটিভ।’
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। যেজন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করছি। নির্বাচনটা যেন অর্থবহ হয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে আমরা বামপন্থি ও গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নিয়ে পৃথক বলয় গড়ে তুলবো।
এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, নির্বাচনকালীন কি ধরনের সরকার থাকবে সেটির চেয়ে আমাদের কাছে ধর্তব্য হলো- নির্বাচনে কালো টাকার খেলা ও প্রশাসনের কারসাজি বন্ধ করা এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা।’
বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, নির্বাচন যদি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে আমরা অবশ্যই অংশ নেব। বামপন্থি, উদার ও গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নিয়ে আমরা পৃথক একটি বলয় তৈরির চেষ্টা করছি, এ বছরের নভেম্বর নাগাদ হয়তো সেটি কাঠামো পেতে পারে। ইত্তেফাক
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১১:০০ এ.এম, ২০ জুলাই ২০১৭,বৃহস্পতিবার
ইব্রাহীম জুয়েল